ফেসবুকে আইএস’র পক্ষে প্রচারণা: ময়মনসিংহ থেকে তরুণ গ্রেফতার

ময়মনসিংহ থেকে 'নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন' এর সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে মো: রাকিব আল হাসান নামের এক তরুণকে আটক করেছে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। ১০ জুলাই আটকের পর ময়মনসিংহ কোতয়ালী থানায় রাকিবের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের করে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
রাকিবের বাড়ি শেরপুর সদরের গাজীর খামার এলাকায় হলেও তিনি ময়মনসিংহ শহরে একটি মেসে থাকতেন। সেখান থেকেই তাকে আটক করা হয়।
রাকিবের বাবা দিনমজুর লাল চাঁন মিয়াও দ্য ডিসেন্ট-কে ছেলের গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেই গ্রেফতারের খবর জানতে পারেন।
'ময়মনসিংহ ডিবি অফিসে গিয়ে রাকিবের সাথে দেখা করছি। কলেজে পড়ার জন্য শহরে থাকতো আমার ছেলে। আমি গরিব মানুষ, কিছুই বুঝতেছি না কী হইছে'।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত রাকিব ময়মনসিংহ নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মামলার এজাহারে রাকিবের বয়স ২০ উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১০ জুলাই রাতে কোতয়ালী থানার সানকিপাড়া রেলক্রসিং এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। পরদিন ১১ জুলাই কোতয়ালী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলাটি করা হয়।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাকিবকে আদালতে পেশ করা হলে বিচারক ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ১৭ জুলাই তাকে পুনরায় আদালতে পেশ করা হলে তাকে জেল হাজতে পাঠান আদালত।
ময়মনসিংহ কোতয়ালী থানার ওসি মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি শুধু মামলা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে এর বাইরে কোন তথ্য দেননি।
এজাহারে 'নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন' এর সাথে যুক্ত থাকার কথা বলা হলেও কোন নিষিদ্ধ সংগঠন তা উল্লেখ করা হয়নি।
তবে মামলার বাদী এটিইউ'র উপপরিদর্শক পলাশ আলীর সাথে কথা হলে তিনি জানান রাকিবকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও জানতে তিনি তদন্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলেন।
তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মফিজুল ইসলামের সাথ কথা বললে তিনি রাকিবকে আটক ও রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে তদন্তাধীন বিষয় বলে এ ব্যাপারে তিনি আর কোন তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
এন্টি টেররিজম ইউনিটের মিডিয়া বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ব্যারিস্টার মাহফুজুল হক জানান তিনি ছুটিতে রয়েছেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্ত রাকিব ফেসবুকে নিষিদ্ধ সংগঠনের পক্ষে উগ্রবাদী কনটেন্ট প্রচার করেছেন এবং অন্যান্য সদস্যদের সাথে তা আদান-প্রদান করেছেন।
এছাড়াও বলা হয়েছে, তার নিজ নাম ও ছদ্মনামে ১২টি ফেসবুক আইডি ব্যবহার করতেন রাকিব। এসব আইডির তালিকাও দেয়া হয়েছে। তার ১৯টি জিমেইল আইডিসহ, ইমু, টেলিগ্রাম ও এক্স আইডি থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
ফেসবুকে কী প্রচার করতেন রাকিব?
রাকিবের নিজের নামে খোলা একটি আইডির বিভিন্ন পোস্ট যাচাই করেছে দ্য ডিসেন্ট। যদিও ২৩ জুলাইয়ের পর থেকে তার নামে থাকা আইডিসহ বাকি ছদ্মনামের আইডিগুলো আর সক্রিয় নেই। তবে মূল আইডির বেশ কিছু পোস্ট আর্কাইভ করে রেখেছে দ্য ডিসেন্ট।
রাকিব তার মূল আইডিতে নিজের বিভিন্ন ছবি আপলোড করতেন যার বেশিরভাগই ছিল একটি জিমে ব্যায়ামরত অবস্থার। নিজের এমন একটি ছবি শেয়ার দিয়ে রাকিব ইংরেজিতে ক্যাপশন দিয়েছেন "জন দ্য জিহাদি"।
"জন দ্য জিহাদি" বা 'জিহাদি জন' হচ্ছে কুখ্যাত এক আইএস জঙ্গি যাকে সংগঠনটির প্রচার করা বিভিন্ন ভিডিওতে বন্দী মানুষদের জবাই করতে দেখা যেত।
কভার ফটোতে নিজের ছবির সাথে এডিট করে আইএস এর পতাকা যুক্ত করে পোস্ট করেছেন এবং ক্যাপশন দিয়েছেন 'Soldier of IS'.
রাকিবের ফেসবুকে আইডিতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস'র মতাদর্শের পক্ষে দেয়া বিভিন্ন পোস্ট পাওয়া গেছে। রাকিবের পোস্টে নিয়মিত কমেন্ট করতেন এমন কয়েকটি আইডি থেকেও আইএসের পক্ষে প্রচারণা চালানো হতো বলে দেখা গেছে।
গত ১৩ জুন একটি পোস্টে আইএস এর সাবেক প্রধান আবু বকর বাগদাদীর একটি ভিডিও বক্তব্য শেয়ার দিয়ে রাকিব ক্যাপশন দিয়েছেন, 'আমাদের যুবরাজ, কুফফারদের আব্বু'।
২৪ মে নিজের একটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দিয়েছেন, 'বিদ্রোহী, বিপ্লবী, মৌলবাদী, আমি জঙ্গিবাদী'।
ইরাকে আইএস সদস্যদের দ্বারা অতীতে বিভিন্ন ব্যক্তিকে জবাই করে হত্যার একাধিক ভিডিও রাকিব তার আইডিতে পোস্ট করেছিলেন।
আইএস সন্ত্রাসীরা এক রাশিয়ান নাগরিককে জবাই করছে এমন ভিডিও পোস্ট করে রাকিব লিখেন, 'রাশিয়ান শুওর জবাই করছি মালুদের খাওয়াবো, মালুদের জবাই করে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো'।
বেশ কয়েকজন যুবককে আইএস সন্ত্রাসীরা জবাই করছে এমন একটি ভিডিও শেয়ার দিয়ে রাকিব লিখেছেন, 'হে আমার জাতি, ভোর এসে গেছে'।
আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ নামে বাংলাদেশি একজন আলেম আল-কায়দা এবং ওসামা বিন লাদেনের সমালোচনা করছেন এমন একটি ভিডিও পোস্ট দিয়ে রাকিব লিখেন, 'ওসামা তোমার আব্বো, তোমার ডেডি'।
শিয়া মুসলিমদের একটি মসজিদ আইএস জঙ্গিরা ধ্বংস করছে এমন একটি ভিডিও শেয়ার দিয়ে ১ জুন রাকিব লিখেছেন, 'পিতা ইব্রাহীম আ: এর সন্তানেরা শিরকের কারখানা, শিয়াদের মন্দিরগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে সমান করছে'।
গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের সংঘর্ষ নাই– প্রয়াত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাইদীর এমন বক্তব্য সম্বলিত একটি ভিডিও শেয়ার দিয়ে রাকিব তাচ্ছিল্য করে ক্যাপশন দিয়েছেন, "বেডা লেহাপরা করো, বড় হুগুর জেহেতু বলেচে তাহলে অইতো ঠিগি বলেছে'।
যা বললেন রাকিবের বাবা এবং একজন প্রত্যক্ষদর্শী:
ময়মনসিংহ শহরের এক বাসা থেকে রাকিবকে আটক করার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম।
তিনি দ্য ডিসেন্টকে বলেন, 'আমিও এখানে ভাড়া থাকি। রাকিব অল্প কিছুদিন আগে ওই বাসায় ওঠে। তার বাসায় যেতে হলে আমার বাসার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। দরজায় তালা লাগানো ছিল বলে পুলিশ আমাকে তালা খুলে দিতে বলে এবং তাদের সাথে ওই বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করে। পুলিশ তাকে আটক করার পর আমাদের সামনে তাকে ফেসবুক খুলে দেখাতে বলে। সেখানে তার আইডিতে আইএসের পক্ষে প্রচারণা চালানো বিভিন্ন পোস্ট দেখেছি'।
দ্য ডিসেন্ট মোবাইল ফোনে কথা বলেছে রাকিবের বাবা লাল চাঁন মিয়ার সাথে। ছেলে গ্রেফতার হওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, জেল থেকে ফোন করার পর তিনি গ্রেফতারের বিষয়টি জানতে পারেন। রিমান্ড চলাকালে ময়মনসিংহ ডিবি অফিসে গিয়ে দেখা করেছেন ছেলের সাথে।
দিনমজুর লাল চাঁন বলেন, 'আমি সরল সোজা মানুষ, আমি গরীব একটা মানুষ। বড় আশা করে ছেলেকে পড়ালেখা করতে দিছি ময়মনসিংহ। ছেলেটারে নিয়ে একটা আশাভরসা আছিল। জানিনা কোন দোষে কোন ব্যাপারে কিসের মধ্যে পড়ছে। আমি বুঝিনা, আমি মূর্খ মানুষ'।
তিনি বলতে থাকেন, 'ছেলে ময়মনসিংহ থাকতো, আমি ময়মনসিংহ আসতে পারি না। আমি গরীব মানুষ, ট্যাকার অভাবে। দুইশ-তিনশ' টাকা গাড়িভাড়া লাগবো। তাই কোন সময় যাওয়া হয় নাই। ছেলের প্রতি বিশ্বাস করছি। বলছি, বাবা তুমি লেখাপড়া নিয়াই থাইকো। পরবর্তীতে কী হইসে আল্লাহ জানে আর ওরা জানে'।
ছেলের বিষয়ে বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা লাল চাঁন।
কী অভিযোগে ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে বিষয় জানেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে লাল চাঁন মিয়া বলেন, 'মোবাইলে নাকি আইডি খুলে ছবি দিছে। আইডি আবার নষ্ট হয়ে গেছে। পরে আরেক আইডি খুলছে। এভাবে নাকি কয়েকটা আইডি খুলছে। আইডিতে নাকি ইসলামি জিহাদি ছবি দিছে'।
ছেলেকে মোবাইল কিনে দেয়ার বেশি দিন হয়নি বলে জানান বাবা। তিনি বলেন, 'সে বায়না ধরায় কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে দিছি মোবাইল কিনার জন্য।'
'একবার ছেলে বলছিল আমার এক বড় ভাই আছে। আমি বলছি বাবা বড় ভাই দিয়া কী করবা। তুমি লেখাপড়া নিয়া থাকবা'। যোগ করেন লাল চাঁন মিয়া।
Comments