আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দিনে ১১ খুন

'মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয় কীভাবে?' গত বুধবার দিনের আলোয় মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যার ভিডিও দেখে সবার মুখেই এমন কথা। সোহাগকে অনেক মানুষের সামনে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়।
গত ১ জুন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের বিএনপি নেতা মহব্বত হোসেন ও ইউনুছ আলী খুন হন। বিএনপির স্থানীয় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন এ দুই ভাই। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১১ জন মানুষ খুন হচ্ছেন। গত মাসে মুরাদনগরের ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। অপরাধীদের ভয়ে এগিয়ে আসছেন না সাধারণ জনগণও। এতে জনমনে তৈরি হওয়া উদ্বেগ ও ক্ষোভ দুটোরই প্রকাশ দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সারা দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া খুনের মামলার তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধ পরিসংখ্যান তৈরি করে পুলিশ সদর দপ্তর। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে খুন হন ২৯৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০। পরের মাসে খুনের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। মার্চে সারা দেশে ৩১৬ জন খুন হয়েছেন। এপ্রিলে ৩৩৬ জন, মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন। জুনে চলতি বছরের সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে সারা দেশে মোট ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ বছরে প্রতি মাসেই খুনের ঘটনা বাড়ছে। বেশি খুন হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন, ঢাকা রেঞ্জ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জে। অনেক খুনের পেছনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের মতো ঘটনা কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ পুরান ঢাকায় ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এ খুনের ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে মিছিল-সমাবেশ করেছে।
খুনের পাশাপাশি সারা দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪টি ডাকাতি হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। এছাড়া এ ছয় মাসে ১১ হাজার ৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গত এপ্রিলে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য এএসএম নাসির উদ্দিন এলান।
পুরান ঢাকায় সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঠিক দুইদিন পর ১১ জুলাই শুক্রবার খুলনা দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছে পুলিশ। মাহবুবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) উপকমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, 'এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি।'
গতকাল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সারা দেশে আধিপত্য বিস্তারকারীদের তালিকা তৈরির কথা জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। পাশাপাশি সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে গতকাল পুরান ঢাকার মিল ব্যারাকে ঢাকা জেলা পুলিশ লাইন, রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ) এবং ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল (টিডিএস) পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'মিটফোর্ডের ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এরই মধ্যে এ ঘটনায় জড়িত মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই নির্লিপ্ত নয়। কিছু স্থানে সামান্য দেরি হতে পারে, তবে প্রতিটি ঘটনায় বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাকশনে যাচ্ছে।'
Comments