ভবিষ্যতের বিমা: কেন বাংলাদেশে জাতীয় বিমা সচেতনতা দিবস এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ

প্রতি বছর ২৮ জুন বাংলাদেশে পালিত হয় জাতীয় বিমা সচেতনতা দিবস—একটি দিন, যা ক্রমশ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পূর্বে তেমন দৃশ্যমান না থাকলেও, বিমা ব্যবস্থার নানা অসংগতি ও অপব্যবহারের প্রেক্ষাপটে দিবসটি গুরুত্ব পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও আর্থিক অস্থিরতা যখন উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর কাঁধে ভর করছে, তখন বীমা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে 'কেন' নয়, বরং 'কত দ্রুত' তা প্রয়োগ করা যায়।
বিশ্বব্যাপী প্রচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হলেও এখন ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)–এর উদ্যোগে এটি জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)–এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিমার প্রবেশ মাত্রা জিডিপির ১ শতাংশের নিচে, যেখানে ভারত প্রায় ৪.২ এবং থাইল্যান্ড প্রায় ৫ শতাংশে রয়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশের বেশি পরিবারই স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিপুল ব্যয় নিজের পকেট থেকেই মেটায়, যাদের বিমা কভারেজ নেই বা অপ্রতুল।
১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশে যখন এক-তৃতীয়াংশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে, তখন পর্যাপ্ত রিস্ক-পুলিং না থাকা কেবল নীতিগত ব্যর্থতাই নয়, আর্থিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। এই দিনটি মূলত তিনটি উদ্দেশ্য সাধন করে—জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বর্তমান বিমা পরিকল্পনার পুনর্বিবেচনা এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ।
যদিও চিত্রটি উদ্বেগজনক, ইতিবাচক ইঙ্গিতও মিলছে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য চালু হওয়া পাইলট প্রকল্পগুলো আশাব্যঞ্জক। ডিজিটাল ওয়ালেট ও ই-কে ওয়াই সি প্রক্রিয়ার জনপ্রিয়তা গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করেছে। ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)–এর মাধ্যমে পরিচালিত পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব হিসেবে রেগুলেটরি স্যান্ডবক্সে মোবাইল রিচার্জ, ফসল চক্র ও রেমিট্যান্সের সঙ্গে বন্দী বিমা পণ্য চালু পরীক্ষা চলছে। তবে শুধু প্রযুক্তি নয়, বিমার প্রতি আস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজন সুস্পষ্ট নীতিমালা, সক্ষম অ্যাকচুয়ারি এবং সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে বিমা বিলাসিতা নয়, বরং দৈনন্দিন ঝুঁকি মোকাবিলায় অবিচ্ছেদ্য একটি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হতে হলে, বিমা সচেতনতা থাকতে হবে বছরজুড়ে। শুধু প্রিমিয়াম আদায় নয়, দরকার বিস্তৃত সুবিধা—সবার জন্য। এর মধ্যে ব্যংকের মাধ্যমে বিমা বিতরণ অর্থাৎ ব্যাংকঅ্যাশিওরেন্স একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ফারজানা চৌধুরীর ভাষায়, 'ব্যাংকঅ্যাশিওরেন্সকে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, কারণ এটি বিদ্যমান ব্যাংক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লাখো মানুষের দোরগোড়ায় বিমা পৌঁছে দিতে পারে'।
ভবিষ্যতের জন্য তাই প্রয়োজন গ্রাহককেন্দ্রিক ডিজাইন ও সহায়ক নীতির সমন্বয়। এমবেডেড বিমা যেমন মোবাইল পেমেন্ট ও রাইড-হেইলিং প্ল্যাটফর্মে একীভূত হচ্ছে, তেমনি প্যারামেট্রিক বিমা—যা নির্দিষ্ট জলবায়ু সূচক পেরুলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেয়—তাও সামনে আসছে। এসব কার্যকর করতে হলে শুধু জুন ২৮ নয়, তার ধারাবাহিকতা গড়ে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কৌশলগত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যেন এই দিনটি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্মাণে জাতীয় ভিত্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
লেখক: একটি তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রধান
Comments