‘মব সন্ত্রাস’ বন্ধ হচ্ছে না, বাড়ছে আতঙ্ক-উদ্বেগ

গত কয়েক মাস ধরে একাধিকবার 'আর মব চলতে দেওয়া হবে না' বলে হুঁশিয়ারি দিলেও এখনও চলছে মবের রাজত্ব। ১৩ মে রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহারিয়ার আলম সাম্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। সাম্য ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এই ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এরা হলেন, তামিম হাওলাদার (৩০), পলাশ সরদার (৩০) ও সম্রাট মল্লিক (২৮)। এদের মধ্যে তামিম আর পলাশ ফুটপাতে ব্যবসা করতেন। সম্রাট করতেন শ্রমিকের কাজ। তাদের গ্রেপ্তারের খবরে বুধবার মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাহ্মন্দী এলাকার তামিমের গ্রামের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল মানুষ।
১৭ মে এই তিনজনকে আদালতে হাজির করা হলে তামিম আদালতে বলেন, আমরা যদি খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতাম তাহলে তো পালিয়ে যেতাম। ওইখানে তো আর বসে থাকতাম না। পুলিশও বলছে, তাকে ধরা হয়েছে সন্দেহভাজন হিসেবে। কিন্তু এরই মধ্যে তামিমের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে তার বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাস করতেন।
প্রশ্ন উঠেছে, যারা মব তৈরিতে জড়িত, তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ব্যাপারে কি করছে?
খোদ পুলিশই মবের শিকার
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, শুধু পুলিশের একার পক্ষে মব বন্ধ করা কঠিন। এখানে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। অভ্যুত্থানের ৯ মাস পরও পুলিশের বিরুদ্ধেই প্রতিদিন গড়ে একটার বেশি মব হচ্ছে। সর্বশেষ এপ্রিলে পুলিশের বিরুদ্ধেই ৩৭টি মব হয়েছে এবং মার্চে ৩৫টি। এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পুলিশ কোনও আসামি গ্রেপ্তারের পর একদল মানুষ সংগঠিত হয়েছে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বা পুলিশের উপর হামলা করে আসামী ছিনিয়ে নিতে চাইছে। তবে এইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি ঘটনার মধ্যে ৭০টি ছিল বড় ধরনের আক্রমণ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩, জানুয়ারিতে ৩৮ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের এই পরিসংখ্যানের বাইরেও সড়কে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলাগুলো করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও মব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। এই মব তৈরি করে শুধু পুলিশের ওপরেই হামলা হচ্ছে তা নয়, বরং কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, পুলিশ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন তাদের ওপর হামলা, হুমকি ও আসামি ছিনতাই বাহিনীটিকে নতুন সংকটে ফেলছে। অনেক ঘটনার নেপথ্যে রাজনৈতিক আশীর্বাদ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা অপরাধীদের রক্ষা করতে পারেন এমন ধারণা কোনোভাবেই গড়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। এ ধরনের ঘটনায় নতি স্বীকার না করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশকে আরও কঠোর হতে হবে।
গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭৪ জন। গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
এ ছাড়া নানা স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৪৯ জেলায় হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
Comments