সেই ভয়াল রাতের কাহিনী: ২৯ এপ্রিল ১৯৯১

সপ্তাহ খানেক গরমে পুড়েছে লোকালয়। সমুদ্রে সৃষ্ট নিম্নচাপ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। সরকারি আবহাওয়া অফিস বার বার রেডিও টিভিতে ঘোষণা দিচ্ছে। সমুদ্র সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি আজ রাত নাগাদ উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করতে পারে। দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত। দশ থেকে কুড়ি ফুট জ্বলোচ্ছাসের আশঙ্কা রয়েছে।
সংবাদটি শুনে একটু বিচলিত হইনি। আবহাওয়া অফিস যা বলে তা কখনো হয় না। তখনো সরকারি কোন মিডিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ছিল না।
সারা দিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পায়চারি চলছে। বাবা সব সময় তাদের দেখা বড় ফ্লাড এর কথা বলতেন। ১৯৬০ সালে দিনের বেলায় যে জ্বলোচ্ছাস বাবারা দেখেছিলেন, তাতে নাকি পানি এদিক দিয়ে ওঠে ওদিকে গড়িয়ে পড়েছিল। তেমন লোকজন মারা না গেলেও সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও ভোলায় নাকি প্রচুর প্রাণহানি ঘটেছিল।
বাবার মুখে সেই কাহিনী শুনে মোটেও ভয় পাইনি। সরল হিসাব কষে বলেছিলাম, যদি দশ ফুট জ্বলোচ্ছাস হয়, এতদুরে আসতে আসতে খাল বিল ভরে বড় জোড় ছয় থেকে সাড়ে ছয় ফুট পানি হবে। আমি উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো যেহেতু উচ্চতা ছয় ফুট আট ইঞ্চি!
তখনো বুঝতে পারিনি কত ভয়াবহ দুর্যোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে!
রাত বাড়ার সাথে সাথে বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। বাড়ছে উৎকন্ঠা! বিদ্যুৎ চলে গেল। পাড়ায় তখন এত দালান কোঠা গড়ে ওঠেনি। সবাই বাঁশের বেড়া ও টিনের ছালার বড় ঘরটিতে জড়ো হলাম। উঠানের কাচারি ঘরটি বাতাসে ভেঙ্গে পড়ে গেছে। বড় ঘরটিও বাতাসে কাঁপছে। বাবা তার ঘর নিয়ে তখনো ঝড়ের মোকাবিলা করতে চাইছে। ষাটের বড় ফ্লাডে এ ঘর পড়েনি! এবারও পড়বে না! আমরা দেখছি বড় ঘরটিও পড়ে যাচ্ছে। বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ২৫০ থেকে ২৮৫ কিলোমিটার।
মায়ের পরামর্শে সবাই পেছনের সেমিপাকা ঘরে আশ্রয় নিলাম। সেখানে দুই রুমে বড় ও মেজভাই-ভাবীরা থাকেন। বাবার ঘরটি বাতাসের কাছে হেরে গিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়েছে। বাবা তখনো সেই ঘর ছেড়ে আসছেনা। তার বিশ্বাস গেরস্ত থাকলে ঘর সাহস পাবে! একপ্রকার জোর করে বাবাকে ও ঘর থেকে বের করা হলো। রাত বাড়ে। ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছুঁলো। সবাই জড়োসড়ো হয়ে মেজ ভাইয়ের রুমে বসেছিলাম।
হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করলো, পানি এসে গেছে! দরজা খুলতেই প্রবল বেগে গলগলিয়ে পানি ঢুকলো। নারীরা ঘাবড়ে গেল। কান্না জুড়ে দিল কেউ কেউ। আমরা পানিতে দাঁড়িয়ে মহিলা ও শিশুদের ঘরের সিলিংয়ে তুলে দিলাম। পানি তখনো বাড়ছে! ঘরের ভেতরে বুক সমান পানি! মা বেশ চমৎকার বুদ্ধি দিলেন। ঘরটির একটি দরজা। যদি পানিতে ঘর তলিয়ে যায় কেউ বের হতে পারবো না! তাই সিলিং থেকে সবাইকে নামিয়ে জলে ভাসা বড় ঘরটির টিনের চালায় সবাই আশ্রয় নিলাম। সারারাত ঝড় বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটা নীরবে হজম করে নিলাম। মনে মনে ভেবেছি আমাদের মতো সব প্রতিবেশি বেঁচে গেছে!
সকাল হতে হতে পানি ঘর থেকে নেমে গেল। উঠান আর রাস্তায় পানি ছিল। মা ভাবীরা রান্না ঘরে গিয়ে ভেজা চাল ডাল কুড়িয়ে নিল। রান্না ঘরেই পাওয়া গেল বড় বোয়াল মাছ! বাড়ির বাইরে এসে দেখি জনপদের চেহারা পাল্টে গেছে!
রাস্তার পাশে ইলেভেন কোয়ার্টারে একজন পুরুষ মারা গেছেন। কতদুর হেঁটে গিয়ে দেখি এলাকার পরিচিত পুরনো ধোপা মন্টু চন্দ্রের বউয়ের লাশ! আরো কিছুদুর গিয়ে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম! ইসলাম চৌকিদারের বাড়ি। নারী শিশু যুবক মিলে ৪৭ জন মারা গেছে। একই ঘরের চালার নিচে সবাই মারা গেছে। লাশ আর লাশ! একসাথে একটি গণকবরে তাদের কবর দেয়া হলো। সেই থেকে বাড়িটির নাম বদলে হয়ে গেল লাশ ঘাঁটি।
ভয় আর উদ্বেগ শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল করে দেয়। একদিন পরে খবর আসে ডাঙ্গারচর আমার বড় মামা, মামার ছেলে-মেয়ে আর নানী মারা গেছেন। মাকে জানানো হয়নি সেই দুঃসংবাদ। তিনদিন পরে তাদের লাশ পাওয়া গেছে। দাফন করার পর ধীরে সুস্থে মাকে সেই ভয়াবহ সংবাদটি জানানো হলো! বৈরী পরিবেশে মা তার মায়ের মরা মুখটিও দেখলো না!
পরের প্রতিটি দিন রাত কেটেছে চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায়। এরপর বাবা আর তার দেখা বড় ফ্লাডের গল্প বলেনি। এতো ছিল পতেঙ্গা মাইজপাড়ার চিত্র। দেশের সবকটি উপকূলীয় এলাকায় লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।
Comments