হুমায়ূন আহমেদ ও অল্প বয়সী মেয়ে
বৈকালিক পত্রিকার সম্পাদক শহীদুল আজম অস্থির হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পরপরই উচ্চকন্ঠে কথা বলছেন। একে ওকে ধমকাচ্ছেন। তার যুক্তি একটাই, এই পত্রিকা বিকেলের পত্রিকা। কিন্তু এটি ধীরে ধীরে অন্যসব পত্রিকার মতো হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কেন এই পত্রিকা পাঠক পড়বে? নতুন কিছু চাই, অন্য কিছু চাই। অকাট্য যুক্তি বটে!
বার্তা সম্পাদক জাকারিয়া মুক্তা নিজের চকচকে টাক মাথায় হাত বুলান। মুখটা সবসময় হাসি হাসি করে রাখেন। তিন মাস ধরে যে অফিসের সংবাদ কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না তা তিনি বুঝেন। কিন্তু তাঁর কিছুই করার নেই। টাকা না পেলে আমারও কাজে মন বসে না। এর মধ্যে গত কয়েকদিন পাউরুটি খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। বাড়িওয়ালার ভয়ে রাতে দেরি করে বাসায় ফিরি। এরপরও শীতকালে ঠোঁট ফাটলে মুখটা যেমন হাসিহাসি হয়, তেমন মুখ করে হাজির হই মুক্তা ভাইয়ের সামনে।
: ভাই হুমায়ূন আহমেদের একটা অন্যরকম ইন্টারভিউ করতে চাই।
: হুম, পারবেন?
: দেখি ভাই চেষ্টা করে।
: করেন পারলে।
মুক্তা ভাইকে আড়ালে আমরা অসীম ধৈর্যের অধিকারী বলে ডাকি। কোনো কিছুতেই তাঁর বিরক্তি নেই। আমার প্রস্তাবে খুশি হয়ে উঠলেন আজম ভাইও। যে কোনো নতুন কিছু পেলেই উনি খুশি। কিন্তু আমি খানিকটা বিরক্ত। যতোটুকু শুনেছি হুমায়ূন আহমেদ রাশভারী মানুষ। সহজে সাক্ষাৎকার দেন না। তাছাড়া পূর্ব পরিচিতও নই। এখন মনে হচ্ছে বিপদে পড়লাম।
ফোন করলাম হুমায়ূনের ছোট ভাই কাটুনিস্ট আহসান হাবীবের কাছে। তিনি জানিয়ে দিলেন এ বিষয়ে তাঁর কথা শুনবেন না হুমায়ূন আহমেদ। এবার সরাসরি ফোন করলাম ধানমন্ডির 'দখিনা হাওয়া'য় হুমায়ূন আহমেদের বাসায়। ফোন ধরলেন তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী শাওন। আমি আর্জি জানালাম। উনি ফোন দিলেন হুমায়ূন আহমেদকে। ফোন ধরেই তিনি বললেন,
: দূর মিয়া, তুমি কি নতুন কিছু জিজ্ঞাসা করবা?
: জ্বি স্যার, আমি নতুন কিছু জানতে চাই।
: তাইলে আসো, এখনি আসো।
ফটোগ্রাফার দুলালকে (সে নিজেকে ফটোড্রাইভার বলে। কারণ তার মোটরসাইকেলের পেছনে সবসময় একজন রিপোর্টার ট্যাগ করা থাকে) নিয়ে ছুটলাম ধানমন্ডির দিকে। অলি গলি পেরিয়ে দ্রত ছুটছে সে। মাঝে মাঝে এই ওই গাড়িতে ঠোক্কর খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন। গরম পড়ছে খুব। ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার ডাব খাওয়ার শখ হলো। বিরক্ত লাগছে। বুঝতে পেরে গাড়ি যেন বিমানের ইঞ্জিন লাগালো।
রিশেপসন পেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই অবাক। দরজা খোলা! দেয়ালে পেইটিং ঝুলছে। বেতের সোফা কিছুটা আগোছালো। সামনে একটা জলচোকি। একপাশে কাগজ, কলম। সিগারেটের স্ট্রে। এর পাশে একটি বাটিতে কালি! কিছুক্ষণ পর এলেন তিনি। হা করে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে। অবাক হলাম। পরনে লুঙ্গি। এমনভাবে পরা মনে হচ্ছে এই বুঝি খুলে পড়ে একটা সর্বনাশ বাঁধাবে। হাওয়াই শার্টের বোতামও খোলা। মাথার দু'পাশ দিয়ে কালি বেয়ে পড়ছে। বুঝলাম, চুলে কলপ করছেন। ঠোঁটে সিগারেট পুরে বললেন, 'হাঁ বন্ধ করে শুরু করো।'
জানতে চাইলাম, 'মাথায় কালো কলপ কেন?'
সহজ উত্তর হুমায়ূনের, 'আমি অল্প বয়েসী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি। ওর সামনে পাকা চুল নিয়ে ঘুরতে ভালো লাগে না। বৃদ্ধ মানুষকে দেখতে কার ভালো লাগে। এ কারণে চুলে কলপ লাগাই, রঙ চঙা শার্ট পড়ি। বয়সকে কমিয়ে ফেলার হাস্যকর প্রচেষ্ঠা আর কী!' অভিনেত্রী শাওনকে মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে করেছেন তিনি।
অল্প বয়সী মেয়ের সূত্র ধরেই তাঁর বই আর চলচিত্রের নায়িকাদের প্রসঙ্গ। কয়টি বই প্রকাশ হয়েছে সেটার কোনো সংখ্যা জানা নেই হুমায়ূন আহমেদের। সে কারণে প্রতিটা নারী চরিত্রও তাঁর মনে নেই। বললেন, 'একেক বইয়ের নারী চরিত্র একেক রকম। আলাদাভাবে বলতে গেলে কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া জেনারেলাইজেশন করাটাও ঠিক হবে না। হিমু বা মিসির আলীকে তৈরি করেছি। কিন্তু এভাবে আলাদা কোনো নারী চরিত্র তৈরি করিনি। হিমু তৈরি হয়েছে কিন্তু হিমি বানাইনি। তাঁর বইয়ের নারী চরিত্রগুলো কেমন? আমার নারী চরিত্রের মধ্যে কোনটা আনন্দময়ী নারী, কোনোটা ক্ষুদ্ধময়ী প্রতিমা। কোনটা রাগী, কোনোটা স্বাভাবিক। কেউ থাকবে হাসিখুশি এটাই নিয়ম।'
হুমায়ূন এর নারী চরিত্রের মধ্যে অদ্ভূত একটা ব্যাপার থাকে। আসলে কি তিনি ইচ্ছে করেই এটা সৃষ্টি করেন?
'এভাবে আসলে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করা হয়নি। যেমন হিমুর বান্ধবী রূপা। এটা আসলে হিমুর কারণে। ওই বইয়ের সব চরিত্রই রহস্যময়।'
বইয়ের এতগুলো নারী চরিত্রের মধ্যে তিনি কখনো খুঁজে ফেরেন নিজের স্বপ্নের নায়িকাকে, প্রেমিকাকে। বইয়ের কোনো নারী চরিত্রকে কি মনে হয়নি প্রেমিকা? জানার আগ্রহ বাড়ে আমার। পাঠক হিসেবে, সাংবাদিক হিসেবে। একটা ভয়ও কাজ করে। এই বুঝি তিনি রেগে যাবেন। আবার কখনো সুযোগ পাওয়া যাবে তার কাছাকাছি আসার। ক্ষণিক থামলেন তিনি। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লেন।
'প্রেমিকারা কি আলাদা কিছু। তাছাড়া এই বুড়ো বয়সে আর প্রেমিকা খুঁজতে যাবো কোথায়? তবে লেখার অর্থে কোনো নারীকে খুঁজিনি। কারণ সৃষ্টির সব চরিত্রই নিজের মনের মতো করে গড়া।'
হুমায়ূন আহমেদ প্রজন্মের যে ব্যবধান সেটা অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছেন। সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় তিনি। কী করে সেটা সম্ভব। তিনি কি ভাবেন?
'এটা আমি আসলে বলতে পারব না। এটা বলতে পারবেন মনস্তত্তবিদরা। কেন বাকের ভাইয়ের জন্য মিছিল হয়। আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। আর কেনইবা বহুব্রীহী নাটকের জন্য ডাক্তাররা আমাকে গালিগালাজ করেন সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।'
হুমায়ূন আহমেদের বই মানেই আনন্দের কিছু। যেখানে হাস্যরসের ছড়াছড়ি। এর জন্য কোনো আলাদা পরিশ্রম করতে হয় না তাকে। এসব যেন সরাসরিই আসে। তাঁর বাসার দেয়ালে টাঙানো একটা ছবি দেখিয়ে জবাব দিলেন,
'এই যে একটা ছবি, সেটা প্রথমে দেখে ভালো লাগতে হবে। পরে তার শিল্পমূল্য বিচার করা হবে। মাথার মধ্যে যখন যেটা আসে সেভাবেই লেখি।'
লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের চোখ দিয়ে কেমন দেখেন নারীদের। প্রশ্নে উঠে আসে সে প্রসঙ্গও। মেয়েদের কথা বলতে তিনি একটু আয়েশ করে বসেন। আমার দিকে চোখ রাখেন।
'দশটি মেয়ে দশ রকম। মেয়ের সৌন্দর্য্য ব্যাপারটার সংজ্ঞা কেউ দিতে পারে না। এটা মনের ব্যাপার। যেমন আমার প্রথম লেখা 'শঙ্খনীল কারাগার' এর নায়িকা কালো। কিন্তু সে সুন্দর। আফ্রিকার মেয়েদের দেখলে আমাদের অনেকের হয়তো ভালো লাগবে না। বড় বড় চোখ, দাঁত। কিন্ত সেদেশে অনেকে তাদের জন্য পাগল।'
তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সবার চেয়ে আলাদা চরিত্রটি হুমায়ূন। বললেন, 'আমি সবার চেয়ে একটু আলাদা। জীবনটাকেও সেভাবে দেখি সে কারণে আমার বইয়ের মধ্যে একটা সবার চেয়ে আলাদা চরিত্র থাকে।'
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সিগারেটে লস্বা টান দেন তিনি। চুলের কলপের কালো রঙ গালে নামতে থাকে। তবে এই অবস্থায় ছবি তুলতে তাঁর আপত্তি। বললেন, আরেকদিন এসে ছবি নিয়ে যাবে। বাসায় গৃহকর্মী নেই। সেটি অকাতরে জানান দেন। বলেন, 'একজন আছে সে কোথায় থাকে কখন থাকে আমিও জানি না।'
শাওন এরপর দু'প্লেট মিষ্টি নিয়ে আসেন। হুমায়ূন রসিকতা করেন, 'মিষ্টি ঠিক আছে কিনা দেখো। অনেক দিনের পুরনোও হতে পারে।' দুলাল মুখের মধ্যে অর্ধেক মিষ্টি ততোক্ষণে পুরে ফেলেছেন। এবার থামেন। নজর এড়ায় না হুমায়ূনের। শাওন আস্বস্ত করেন। মিষ্টি ঠিক আছে।
পাশের বাসা থেকে প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম উঁকি দেন। সরে যেতেই বলেন, 'লেখার তাগাদা, টাকা নিয়ে বসে আছি। লেখাতো দিতেই হবে। এখন তোমরা বিদায় হও।'
আসার সময় উপহার পেলাম বই। তাঁর লেখা বই 'আমার আছে জল, অটোগ্রাফসহ। বইয়ের শুরুটা এমন, জানেন আমাদের বাসায় কোনো আয়না নেই'। ভাগ্যিস হুমায়ূন এর সামনে কোনো আয়না নেই। যেখানে তাঁর সমকক্ষ কারো ছবি থাকতে পারে। তিনি নিজেই নিজের সমকক্ষ। এমন সব ভাবনা নিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরি। এবার ডাব খাওয়ার বায়না ধরে দুলাল। পার্কে বসে থাকা যুগলদের ছবি তোলেন। আফসোস করে আমাকে বলে,
'সৌম্য, আমি কিন্তু গোপনে ছবি তুলেছি। কী করবো বলো? হুমায়ূন আহমেদকে দেখে কি ছবি তোলার লোভ সামলানো যায়।'
-
সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্প।