পোশাক শ্রমিকরা কেন বারবার রাস্তায় নামেন?
পোশাক শ্রমিকদের সর্বশেষ বিক্ষোভটি থেমেছে ৫২ ঘন্টা পর। গত শনিবার সকাল নয়টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ শুরু করেন টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার সহস্রাধিক শ্রমিক। আগামী রোববারের মধ্যে বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাসে রাত সোয়া ১০টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকেরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গাজীপুরে গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। অবরোধ ছাড়াও অনেক স্থানে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। তবে সেগুলো কারখানা এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ে জেলায় অন্তত ৪০টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বলে শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এতে করে সেখানকার শিল্প বাণিজ্য ও সামাজিক পরিসরে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
দাবি আদায়ে সড়কে নামে কেন পোশাক শ্রমিকরা? এমন প্রশ্নের সহজ উত্তর এই যে পথে না নামলে দাবি আদায় হয় না।
বিক্ষোভের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিজিএমইএ আগেই বলে দিয়েছিল যে, শ্রমিকেরা যদি কাজ না করেন বা কারখানা থেকে বের হয়ে যান, তাহলে মালিকেরা শ্রম আইন অনুযায়ী কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন। অর্থাৎ কারখানায় কাজ না করলে শ্রমিকেরা মজুরি পাবেন না। অন্যদিকে, শ্রমিকরা বলেন - মজুরি নিয়ে শ্রম অসন্তোষ ও শ্রমিক নিহতের ঘটনার সম্পূর্ণ দায় মালিকদের। কিছু কারখানা অবশ্য আবার উৎপাদনে ফিরেছে।
মজুরি বাড়ানো নিয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামা পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হবে, এর আগেই কি সমাধান করা যায় না? বলা হচ্ছে বিষয়টা অনেক জটিল।
গত বছর গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণাও আসে। তবে বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি কারখানা কর্তৃপক্ষ খরচ কমানোর জন্য ধীরে ধীরে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করে। ছাঁটাই শ্রমিকেরা পরে আর চাকরি ফিরে পাননি। আবার নতুন করে চাকরি নিতে গিয়ে দেখেন বেতন আগের চেয়ে কম পাচ্ছেন। যার কারণে তাঁরাও আর চাকরিতে ফিরতে পারেননি। সরকার পরিবর্তনের পর তাঁরাই কারখানাগুলোয় জড়ো হয়েছেন চাকরি ফিরে পেতে। আবার কিছু কারখানায় নতুন নতুন দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন হচ্ছে। দাবি আদায় করতে শ্রমিকেরা অবরোধ করছেন মহাসড়ক। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ এই সঙ্গে অন্যান্য বাবসা বাণিজ্য।
গত দেড় দশকে স্থানীয় মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি ও মারধর এবং মামলা–গ্রেপ্তার করে শ্রমিক বিক্ষোভ বা আন্দোলন দমন করেছে মালিকপক্ষ। এমনকি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসা হয়। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখনও বিরাজমান। ৫ আগস্টের পর বিক্ষোভের বড় কারণ ছিল ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিকদের দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগ মাস্তানদের হাত থেকে বিএনপির কোন ক্যাডারের হাতে যাবে সেটাই ছিল আসল কারণ। তারাই শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের মতো ভূমিকা রাখতে না পারায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বিজিএমইএর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন নেতা আত্মগোপনে থাকায় নেতৃত্বেও কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে।
এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এসেছে, কিন্তু সংকট কাটেনি। ইতিমধ্যে আগামী মৌসুমের ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্য দেশে চলে গেছে বলে আশংকা করা হচ্ছে। কথায় কথায় কারখানায় বিক্ষোভ, ধর্মঘট, আন্দোলন আর দাবিদাওয়ার কবলে পড়ে ক্রয়াদেশ ও উৎপাদন ঝুঁকিতে। নানা ছুতোয় কর্মীরা অপ্রচলিত ইস্যু সামনে এনে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে খারাপ বার্তা যাচ্ছে বহির্বিশ্বে। এর মধ্যে বিদেশি ষড়যন্ত্র দেখছেন অনেকেই। সেটা থাকতেই পারে। তবে সমাধান খুঁজতে হবে আমাদের নিজেদেরই। মজুরি কাঠামো ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা ও মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া সংকটের সমাধান হবে না।
লেখক: সাংবাদিক