যানজটে নগর জীবন
ঢাকা যানজটের শহর। স্থবির শহর। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ঢাকা পরিণত হয়েছে মিছিল আর সমাবেশের নগরীতে। শিক্ষার্থী, চাকরি প্রার্থী, পেশাজীবীসহ ধর্মীয় সংগঠনের কর্মীরা মিছিল আর সমাবেশ ডেকেই চলেছেন। যেমনটা আজ ছিল উলামা মাশায়েখ বাংলাদেশ-এর ডাকা মহাসম্মেলন। মহাসম্মেলন যোগ দিতে হাজার হাজার অংশগ্রহণকারী রাস্তায় নামেন। ভরে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং এর আশপাশের এলাকা। ভোর থেকেই রাজধানীর সড়কে আজকের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বহনকারী বিভিন্ন যানবাহন চলতে দেখা যায়। অনেক অংশগ্রহণকারীকে পায়ে হেঁটেও সম্মেলন স্থলের দিকে যেতে দেখা গেছে। সকাল থেকেই তীব্র যানজট শুরু হয় নগরীতে যা চলে শেষ দুপুর পর্যন্ত।
মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, উড়াল সেতুসহ নানা স্থাপনা করেও যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তার মধ্যে এই মিছিল মিটিং নতুন উপসর্গে পরিণত হয়েছে।
অল্প কিছু 'বিশেষ' সড়ক বাদে কোথাও গাড়ি চলার পথ নেই। ঢাকাবাসী এখন রাতে ঘুমাতে যায় দুঃস্বপ্ন নিয়ে যে তার আগামীকাল সকালে প্রাণটা যাবে যানজটে। ক্ষুদ্র চাকরিজীবীকে ভাবতে হয় চাকরিটা থাকবে তো? হাসপাতালগামী মানুষ চিন্তা করে, তার রোগীকে ঠিকমতো হাসপাতালে নেওয়া যাবে তো? বাঁচানো যাবে তো? শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের ভাবতে হয়,পরীক্ষা হলে, ক্লাসরুমে যাওয়া যাবে তো?
একটা নৈরাজ্যের চিত্র সর্বত্র। একটা সময় ছিল, অফিস শুরুর সময় এবং অফিস ছুটির সময় যানজট হতো। এখন সারা দিনই সড়কে জট। কিছু দিন আগেও মানুষ পরিকল্পনা করতো দিনে অন্তত একটি কাজ শেষ করা যাবে। এখন একটিও করা যায় না।
তবে এ কথা মানতে হবে যে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর প্রভাবে ঢাকার কয়েকটি সড়কে যানজট কিছুটা কমেছে। বিশেষ করে মিরপুর ও উত্তরাবাসী এর সুফল পেয়েছেন বড়ভাবেই। তবে ঢাকার সামগ্রিক যানজট কমেনি। ঢাকার সড়কে মানসম্মত আধুনিক বাসের সংখ্যা না বাড়লে, পথচারীবান্ধব ফুটপাত, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার সীমিত করা না গেলে এবং মূল সড়কে রিকশা বন্ধ করতে না পারলে বড় সাফল্য পাওয়া যাবে না।
মোটা দাগে যে সমস্যাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধান করা যায় তার একটি হলো ব্যস্ত সড়কে পার্কিং বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত ভিভিআইপি ও ভিআইপিদের জন্য রোড প্রটোকল কমিয়ে আনা। হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর সেটা অনেকটাই কমেছে।
ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেল লাইন যাওয়ার ফলে ১৭টি পয়েন্টে রাস্তা বন্ধ করে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এসব পয়েন্টে দিনে অসংখ্যবার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এ নিয়ে জরুরি ভাবনা দরকার। এই শহরে একই রাস্তায় দ্রুতগামী যানবাহন আর ধীরগতির যানবাহন চলাচল করে, তাও আবার একসঙ্গে। একই সড়কে বাস-মিনিবাস, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান, এমনকি ঘোড়ার গাড়িও চলে। ঢাকায় এখনও নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। কিন্তু বাস্তবে ২০ লাখ প্যাডেল চালিত রিকশা চলাচল করে এই শহরে। নতুন যুক্ত হয়েছে যন্ত্রচালিত রিকশা। ফলে যানবাহনের গতি যায় কমে। অনেকেই মানবিকতার কথা বলবে, বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা বলবে কিন্তু রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার কোনও বিকল্প এই শহরে নেই। তেমনি হকারসহ রাজনৈতিক স্থাপনা উচ্ছেদ করে ফুটপাতের মালিকানা পথচারীদের কাছে ফিরিয়ে দিলে যানজট তাৎক্ষণিকভাবে কমবে। আর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক মিছিল মিটিং-এর জন্য রাজধানীর আশেপাশে কোথাও বিকল্প কোন ভেন্যু চিন্তা করা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
যানজট ঢাকাবাসীর জীবনের গতিই শুধু ধীর করে দেয়নি, এর কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের। যানজট সমস্যা মেটাতে বছর পর বছর বৈঠক হয়, প্রকল্প হয়, অর্থ ব্যয় হয়। সমস্যার একচুলও পরিবর্তন হয় না। ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশন আছে। আছে সচিবালয়ভিত্তিক কেন্দ্রীয় প্রশাসনও। এখন থেকেই তারা গুরুত্ব দিয়ে এ সমস্যার দিকে না দেখলে আগামী দিনে রাস্তাতেই হয়তো কাটবে মানুষের দিনরাত।