উল্লাপাড়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তানভীর ইমাম
ঢাকা জার্নাল ডেস্ক: মো. ময়নুল হোসাইন, চলনবিল
ছিলেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রধান সহকারী। ২০১৪ সালে বিনাভোট এবং ২০১৮ সালে রাতের ভোটের মাস্টারমাইন্ড। বাবা এইচ টি ইমামের বদৌলতে কোনো দিন রাজনীতি না করেও ২০১৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া-সলঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য হন তানভীর ইমাম। ২০১৮ সালেও রাতের ভোটে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি বানানো হয় তাকে।
সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনামলের ২০১৪ থেকে ২০২৪, ১০ বছর এমপি ছিলেন তানভীর ইমাম। তার পিতা এইচটি ইমাম ২০০৯-২০২১ সালের মার্চ, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। দীর্ঘ সময় তারা ক্ষমতাধর হিসেবে উল্লাপাড়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। বাবার সুবাদে ছেলের অবৈধ হুকুম তামিলে ব্যস্ত থাকত স্থানীয় প্রশাসন। এই সময়ে দিনেদুপুরে উপজেলার বাখুয়া গ্রামের জামায়াতের স্থানীয় এক নেতা সাইদুর রহমানকে সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ।
নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে উপজেলার পূর্নিমাগাঁতি ইউনিয়নের ফলিয়া গ্রামের নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া শহিদ মাহফুজুর রহমান নামে এক শিবির কর্মীকে। সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে ডজন ডজন মামলা দিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন বিএনপি-জামায়াতের শতশত নেতাকর্মী। নিজ বাসাবাড়িতে ঘুমাতে পারেননি তারা। শুধু বিএনপি-জামায়াত-শিবির নয়, স্থানীয় সাধারণ মানুষও কাহিল ছিলেন তার শাসনামলে। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি-অনিয়ম, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে পুরো উপজেলা মগের মুল্লুকে পরিণত করা হয়। দলীয় নেতাকর্মীরাও হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া। মতের বাইরে গেলেই বিএনপি-জামায়াত তকমা লাগিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হতো জেলে। ছেলেকে না পেলে বাবাকে, বাবাকে না পেলে ছেলেকে আটক করে নিয়ে যেত পুলিশ। বিভিন্ন জায়গায় জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে না পেয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডারদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়রা বলছেন, শিক্ষা ও শান্তির জনপদ খ্যাত উল্লাপাড়াকে জঙ্গী শাসনে রূপ দেয়া হয় গত আওয়ামী শাসনামলে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত আন্দোলনে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। শুধু বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা নয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন উল্লাপাড়ার সাধারণ মানুষও।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মহাজোট। উল্লাপাড়ায় এমপি হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল ইসলাম শফি। দেশের যে কয়েকটি আসনে বিএনপি ও জামায়াত আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল,এর মধ্যে উল্লাপাড়া অন্যতম। ওই নির্বাচনে জামায়াতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে দ্বিতীয় হন। তৃতীয় হন বিএনপির সাবেক এমপি এম আকবর আলী। নৌকা প্রতীকে শফিকুল ইসলাম এমপি নির্বাচিত হলেও ইতোমধ্যে কয়েকবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান অভিযোগ করেছেন ওই নির্বাচনে তাকে ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছে। উপজেলার পশ্চিমের কয়েকটি ইউনিয়নে তখনকার প্রশাসনের সহযোগিতায় দাড়িপাল্লার ব্যালটকে নৌকা হিসেবে গণনা করে তাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে।
উল্লাপাড়ার রাজনীতিতে জনবিচ্ছিন্ন হলেও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমামকে। ক্ষমতায় আসার পরই স্থানীয় প্রশাসন সাজান নিজের মতো করে। এমপি শফিকুল ইসলাম শফি ও এইচটি ইমাম মিলে বিএনপি-জামায়াত নিধনে উঠে পড়ে লাগেন। দেয়া হয় হয়রানিমূলক নানা মামলা। এলাকা ছাড়া হন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীসহ সমর্থকরাও। বিশেষ করে ২০১৩ সালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কেন্দ্রিক জামায়াত-শিবির স্থানীয়ভাবে কঠোর আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন ২০১৪ সালের বিনাভোটের নির্বাচন পরবর্তীতেও বহাল থাকে।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতের ডাকা হরতাল পালনকালে উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্বদেলুয়া বাসস্ট্যান্ডে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ অতর্কিতভাবে গুলি চালায়। এতে স্থানীয় ফলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী শিবিরকর্মী মাহফুজুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে থানায় ফের নির্যাতন চালানো হলে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়।
উল্লাপাড়া পৌরশহরের ঢেউটিন ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম জামায়াত করার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারির কথা। বাখুয়া নিজ গ্রামের মরহুম হাবিবুর রহমানের দোয়া অনুষ্ঠান থেকে সাইদুল ইসলামকে আটক করে তৎকালীন ওসি তাজুল হুদাসহ পুলিশ সদস্যরা। থানায় নিয়ে তার পায়ে গুলি করে ফেলে রাখা হয়। পাশাপাশি চলে নির্যাতন। স্থানীয় জামায়াত নেতারা বলছেন, তৎকালীন ওসি তাজুল হুদা, এসআই জলিল ও আমিনুলসহ অনেকেই জড়িত ছিলেন এই নৃশংসতায়। একপর্যায়ে তাকে পৌরশহরের কাওয়াক হাসপাতালে নিলেও তৎকালীন এমপি তানভীর ইমামের নির্দেশে চিকিৎসা না করিয়ে ফেলে রাখা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তখনকার সদর ইউনিয়নের জামায়াত সেক্রেটারি সাইদুর রহমানের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার কিছু দিন আগে ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি বিরোধীদলীয় জোটের ডাকা হরতাল পালনকালে জামায়াত-শিবিরের অনেকেই আহত হন পুলিশের গুলিতে। এর মধ্যে উল্লাপাড়া উপজেলা শিবির সেক্রেটারি জান্নুন হোসেন ছররা গুলিতে তার দু'টি চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করা হলেও দু'টি চোখ অন্ধ হয়ে মানবতার জীবনযাপন করছেন এই যুবক।
উল্লাপাড়া উপজেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য বাখুয়া গ্রামের আতাউর রহমান, ২০১২ সাল থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নাশকতা, বিস্ফোরকসহ তথাকথিত রাজনৈতিক ৪৮টি মামলা দেয় আওয়ামী লীগ ও পুলিশ। গ্রেফতার করে রিমান্ডের নামে অমানবিক নির্যাতন করা হতো তাকে। তার পরিবার জানায়, আতাউরকে নির্যাতন না করার শর্তে তার পরিবারের কাছ থেকে তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করে তৎকালীন ওসি দেওয়ান কৌশিক এবং এসআই আলহাজ উদ্দিন। তল্লাশির নামে বাড়িঘর, আসবাবপত্র, এমনকি রান্নার মাটির চুলাও ভেঙেছে পুলিশ। লুট করা হয় ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র ও দুইটি গরু। রেহাই পায়নি আতাউরের স্ত্রী, পুত্র, বড় ভাইয়ের স্ত্রী, ভাতিজার স্ত্রী, শ্বশুর ও শাশুড়িও। তাদের নামেও বিস্ফোরক আইনে মামলা করে এবং কয়েকজনকে কারাগারে আটক রাখা হয়।
একই গ্রামে রেজাউল করিম, মোহাম্মদ আলীসহ অনেক নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর করে এবং লুট করে পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডাররা। এক সময় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে বাখুয়া গ্রাম।
সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা সাইফুল ইসলাম বাবলু, বিভিন্ন মেয়াদে ৪৭ মাস কারাভোগ করেন। তৎকালীন ওসি দেওয়ান কৌশিক আহমেদ এই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে চোখ বেঁধে উল্লাপাড়া বাজারে ঘুরিয়েছেন। তাদের বাড়ি ঘর ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও জানা যায়।
উল্লাপাড়া পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক ২০১৪ সালে পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন। গ্রেফতারের পর অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। এমন কি উপজেলার পূর্বদেলুয়া গ্রামের রিকশাচালক আব্দুর রাজ্জাককে জেল খাটতে হয়েছে। এভাবে পুরো উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, আটক বাণিজ্য, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুট করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়।
উল্লাপাড়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. আজাদ হোসেন জানান, তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা রয়েছে। এসব মামলায় জেল খাটতে হয়েছে। বিগত স্বৈরশাসনের সময় তাদের লোকজন বাসাবাড়িতে থাকতে পারেননি। এমনকি নামাজ পড়ার সময় মসজিদেও গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্বীষহ দিন গেছে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছর। জেলখানা থেকে অনেক নেতাকর্মীর বাবা-মা মারা গেছে। তাদের প্যারোলে মুক্তি দিয়ে জানাজায় অংশ নিতেও দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, উল্লাপাড়ায় বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে জুলুম নির্যাতন শুরু হয় শফিকুল ইসলাম শফি এমপি হওয়ার পর থেকে। মাঝখানে তানভীর ইমাম দুই বার ক্ষমতায় এসে এই জুলুম বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। চলতি বছর কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ফের এমপি হন শফি। সরকার পতনের আগে পর্যন্ত শফির ছেলে অ্যাডভোকেট আদর উপজেলার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রথমবার এমপি হওয়ার পর উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দলীয়করণ, নিয়োগ বাণিজ্য করেন এমপি ও তার স্ত্রী। শেষবার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ছিল শফির ছেলের হাতে।
উল্লাপাড়া উপজেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহজাহান আলী জানান, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর থেকে উল্লাপাড়ায় জামায়াত-শিবির দমন মিশনে নামে আওয়ামী লীগ। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে কয়েক দফায় সাড়ে তিন বছর তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। কথিত গোপন বৈঠক, নাশকতা পরিকল্পনা নামে তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দিয়েছে তাদের নেতাকর্মীদের নামে। এমনকি কারাগারে থাকা অবস্থায়ও তার নামে মামলা হয়েছে এবং মামলায় তাকে রিএরেস্ট করেছে। তার ছোট ভাইয়ের নামে কোনো মামলা ছিল না। অথচ তাকে উল্লাপাড়া থানার তৎকালীন ওসি দেওয়ান কৌশিক আহমেদ আটক করে নগদ দুই লাখ টাকা নিয়েছে এবং মিথ্যা মামলায় আটক দেখিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেছে। জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা তো বটেই তাদের সমর্থক ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি।