আজ কোজাগরী পূর্ণিমায় ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পূজা

আজ শুভ কোজাগরী পূর্ণিমা— হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব লক্ষ্মী পূজা পালিত হচ্ছে আজ সারা দেশজুড়ে। বিশ্বাস অনুযায়ী, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দেবী লক্ষ্মী পৃথিবীতে নেমে আসেন ভক্তদের ঘরে ঘরে, যাঁদের ঘরে জেগে থেকে তাঁকে আহ্বান করা হয়, তাঁদের ঘরেই স্থায়ী হন ধন, ঐশ্বর্য ও শান্তির বর নিয়ে।
চাঁদপুরসহ দেশের নানা জেলায় সকাল থেকেই শুরু হয়েছে পূজা প্রস্তুতি। বাজারে দেখা গেছে নতুন পাটির ঝাঁপি, ধান, চাল, কলা, নারকেল, চিনি, মিষ্টি, আতপ চাল, ফুল ও প্রদীপের ব্যাপক বিক্রি। গৃহিণীরা ঘরবাড়ি ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন করে তুলেছেন, মাটির আলপনা এঁকেছেন উঠোনে, আর সাজিয়ে তুলেছেন পূজার মণ্ডপ ও ঘরের পূজাস্থল। সন্ধ্যা নামতেই দেদীপ্যমান প্রদীপে, ধূপের ঘ্রাণে আর ফুলের সুবাসে মুখরিত হয়ে উঠেছে শহর থেকে গ্রাম।
হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসে দেবী লক্ষ্মী হলেন ধন, ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য ও শান্তির দেবী। কোজাগরী শব্দের অর্থ—'কে জেগে আছো'। কিংবদন্তি আছে, এই রাতে দেবী পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, "কে জাগরিত আছো?"— অর্থাৎ কে তাঁর পূজায়, সৎসাধনায় নিমগ্ন। যিনি উত্তর দেন, তাঁর ঘরেই প্রবেশ করেন দেবী লক্ষ্মী, বরদান করেন সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য। তাই এই রাতে ভক্তরা জেগে থাকেন, ভক্তিগীতি, আরতি, মন্ত্রপাঠ ও আলো প্রজ্বালনের মাধ্যমে দেবীকে আহ্বান জানান।
চাঁদপুর শহরের পুরানবাজার শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দিরে সকাল থেকেই চলছে পূজা, সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আরতি ও প্রসাদ বিতরণ। মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তদের ভিড় ছিল উপচে পড়া। নারীরা ঐতিহ্যবাহী লালপাড় শাড়ি পরে, হাতে ধূপ ও প্রদীপ নিয়ে দেবীর আরাধনায় নিমগ্ন ছিলেন।
বেশিরভাগ পরিবারে ঘরোয়া পরিবেশেই লক্ষ্মী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। গৃহিণীরা ধান, চাল, কুমড়ো ও ফলমূল দিয়ে দেবীকে নিবেদন করেন। পূজার আগে ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা ও ধান-চাল দিয়ে আলপনা আঁকা ঐতিহ্যের অংশ। পূজার সময় পাঠ করা হয় 'শ্রীশ্রী লক্ষ্মীচরিত', আরতি শেষে পরিবারের সবাই মিলে প্রসাদ ভাগ করে খান।
চাঁদপুরের ঘোষপাড়া এলাকার গৃহিণী মীনা ঘোষ বলেন, "লক্ষ্মীদেবী আসেন পরিচ্ছন্ন ঘরে। তাই আমরা দিনভর ঘরদোর পরিষ্কার করি, নতুন চাল, নতুন ধান দিয়ে পূজা দিই। বিশ্বাস করি, এই পূজার মাধ্যমে ঘরে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে।"
লক্ষ্মী পূজাকে কেন্দ্র করে গত দুই দিন ধরেই চাঁদপুরের বাজারগুলোতে ছিল উৎসবের আমেজ। মিষ্টির দোকানগুলোয় ছিল রসগোল্লা, সন্দেশ, পায়েস, নাড়ু ও ছানার নানা আইটেমের সাজসজ্জা। ফুলের দোকানগুলোতেও ছিল ভিড়—বিশেষ করে গাঁদা ও শিউলি ফুলের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ।
পাটের ঝাঁপি, বাঁশের চালুনি, ধানের শীষ, মাটির প্রদীপ ও নতুন ধান-চালের ব্যবসায়ীরাও ছিলেন ব্যস্ত। বিক্রেতা মৃণাল কান্তি দাস বলেন, "প্রতি বছরই এই সময় লক্ষ্মী পূজার জন্য ভালো বিক্রি হয়। এবার দাম কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু বিক্রি তেমন কমেনি। সবাই চায় দেবীর আরাধনায় কোনো ঘাটতি না থাকে।"
লক্ষ্মী পূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে নতুন ধানের সঙ্গে যুক্ত এই পূজার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এক সময় কৃষকরা নতুন ফসলের ফলন দেখে দেবীকে ধন্যবাদ জানাতেন এই পূজার মাধ্যমে। এখনো অনেক গ্রামে ধানের শীষ, চাল, গুড় ও আতপ চাল দিয়ে দেবীকে পূজা দেওয়ার রীতি চালু আছে।
পুজোর পুরোহিত বিমল চক্রবর্তী বলেন, "লক্ষ্মী পূজা আসলে একটি শুভ শক্তির আরাধনা। এটি মানুষকে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন, পরিশ্রম ও সততার মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে চলার বার্তা দেয়।"
রাত গড়ালেও ভক্তদের জাগরণ থামে না। অনেক জায়গায় আজ রাত জেগে হবে লক্ষ্মীসংগীত, ভজন ও আরতি। তরুণরা ঘরে ঘরে গিয়ে গান গেয়ে আশীর্বাদ কামনা করেন। কোথাও কোথাও পায়েস, মিষ্টি ও প্রসাদের আয়োজন থাকে প্রতিবেশীদের জন্যও— যা এই উৎসবকে আরও মধুর করে তোলে।
দেশজুড়ে যখন নানা সংকট, মূল্যবৃদ্ধি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ দিন পার করছে, এমন সময়ে লক্ষ্মী পূজা এনে দেয় আশাবাদের বার্তা। ভক্তদের প্রত্যাশা— দেবীর আশীর্বাদে ঘরে ঘরে ফিরে আসুক শান্তি, জীবনে আসুক প্রাচুর্য, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক সৎ উপার্জনের মূল্যবোধ।
চাঁদপুরের পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সুভাষ রায় বলেন, "আমরা প্রার্থনা করছি যেন দেবী লক্ষ্মী সবার ঘরে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আনেন। এই উৎসব আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্যের প্রতীক।
Comments