চট্টগ্রাম বন্দরের পাঁচ টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বে বিদেশি প্রতিষ্ঠান

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা করছে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি)। অপরদিকে আসছে ডিসেম্বরে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে আবুধাবিভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড। এই টার্মিনালে এককভাবে বন্দরের ৪৪ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামা করে। এরবাইরে আরও দুইটি কনটেইনার টার্মিনালের মাধ্যমে পণ্য ওঠানামা হয়। যার একটি চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ও আরেকটি জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি)। এ ছাড়া বে টার্মিনাল-১ ও ২ এবং লালদিয়া নামে তিনটি নতুন টার্মিনাল করতে যাচ্ছে সরকার। এগুলো পরিচালনার দায়িত্বও যাচ্ছে বিদেশিদের হাতে।
লালদিয়ার চরের টার্মিনাল দেওয়া হচ্ছে ডেনমার্কের এপিএম মায়ের্স্ককে। আর বে টার্মিনাল প্রকল্পের একটিতে ডিপি ওয়ার্ল্ড, আরেকটিতে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনালকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে বন্দরের সাতটি টার্মিনালের পাঁচটিই চলে যাবে বিদেশিদের হাতে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে।
আপাতত দুটি টার্মিনাল থাকছে বাংলাদেশি কোম্পানির হাতে। এর একটি সিসিটি; বর্তমানে এটি পরিচালনা করছে সাইফ পাওয়ার টেক। ২০২৭ সালের ডিসেম্বরে তাদের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। জিসিবি পরিচালনা করছে বাংলাদেশি ১২টি বার্থ অপারেটর কোম্পানি।
গেলো ১০ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে এসে চারটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। তবে সব টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ বন্দরের হাতে থাকবে বলে জানান তিনি। চারটির মধ্যে তিনটি টার্মিনাল তৈরি করে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরিচালনা করবে বিদেশিরা। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল আগেই সৌদি আরবের আরএসজিটিকে দেওয়া আছে।
বছরে এখন ৩৩ লাখ কনটেইনার ওঠানামা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। নতুন তিন টার্মিনাল যুক্ত হলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৭৬ লাখ। এটি বন্দরের বর্তমান সক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি। নতুন তিনটি টার্মিনাল তৈরি হবে বিদেশি বিনিয়োগে। ব্যয় হবে ৩৮০ কোটি ডলার। তবে সবচেয়ে বড় টার্মিনাল এনসিটিতে ডিপি ওয়ার্ল্ড নতুন কোনো বিনিয়োগ করবে কিনা, এখনও পরিষ্কার নয়।
এর আগে টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করতে সরকার পরিকল্পনা নিলে তার পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়েছিল বন্দর ব্যবহারকারীসহ বিভিন্ন মহল। বিদেশি বিনিয়োগে সরকার সম্ভাবনা দেখলেও রাজনৈতিক দলগুলো এতে 'ষড়যন্ত্রের' অভিযোগ তোলে। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সংস্কারের পর বন্দর বিদেশিদের হাতে দিলে মুনাফা বাড়বে। তবে এতে খরচও বাড়বে আমদানি-রপ্তানিকারকদের।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রায় ৭শ কোটি ডলারের (৮৪ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে এক ডজনের বেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে তিনটি নতুন টার্মিনাল তৈরি এবং পরিচালনা বাবদ তিনটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ৩৮০ কোটি ডলারের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে সরকার। লালদিয়ায় ৮০ কোটি ডলার এবং বে টার্মিনালের দুটি টার্মিনালে প্রায় ৩শ কোটি ডলারের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কী কী শর্ত প্রতিপালন করতে হবে; কে কত বছর টার্মিনাল পরিচালনা করবে; তারা কনটেইনার ম্যানেজমেন্টের পুরো প্রক্রিয়া নাকি শুধু টার্মিনালে কনটেইনার ওঠানামা করবে; বিদেশি অপারেটর এলে দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যয় কতটা সাশ্রয়ী হবে– এসব বিষয়ে এখনও কিছু খোলাসা করেনি সরকার।
বন্দর কর্তৃপক্ষও প্রকাশ্যে বলছে না কিছু। কিন্তু বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে গিয়ারলেস জাহাজের সংখ্যা কমানো, ট্যারিফ বাড়ানো, এনসিটিকে আরও গতিশীল করাসহ বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারা।
এনসিটিতে এখন গ্যান্ট্রি ক্রেন, স্টাডল ক্যারিয়ারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সবই রয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার আগে এই টার্মিনালে গেলো এক মাসে বেশ কিছু পরিবর্তনও আনা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে আগের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি কনটেইনার ওঠানামা করছে। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সংস্কারের এসব পদক্ষেপ আগে নেওয়া হলে বন্দর আরও গতিশীল হতো।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বছরে ৮শ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে সিকম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আমিরুল হক বলেন, এনসিটিতে সংস্কারমূলক যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা; কিন্তু কার্যকর হচ্ছে এখন।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম-চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান এসএম আবু তৈয়ব বলেন, সক্ষমতার চেয়ে এখন বেশি সার্ভিস দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। তারপরও এটির সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ ছিল। তা কেন এতদিনে হয়নি, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।
তিনি বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কে কোন শর্ত প্রতিপালন করবে; তারা এলে আমাদের পণ্য পরিবহন খরচ ও সময় কতটা সাশ্রয়ী হবে– এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক বোর্ড মেম্বার মোহাম্মদ জাফর আলম বলেন, অবকাঠামো তৈরি করার শর্তে যদি নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তাহলে সেটিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু তৈরি থাকা টার্মিনাল বিনিয়োগ ছাড়া বিদেশিদের দেওয়া কতটা সঠিক, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। পাশাপাশি শুধু টার্মিনাল পরিচালনার সুযোগ না দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার সাথেও যুক্ত করা উচিত। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি কনটেইনার কীভাবে বর্তমানের চেয়ে কম সময়ে কম খরচে নেওয়া যায়, সে প্রক্রিয়ার সাথে তাদের সম্পৃক্ত করা উচিত।
Comments