সিলেটে বিল্ডিং কোড অমান্য করে বহুতল ভবন নির্মাণ

সিলেট মহানগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাঠান পাড়া আবাসিক এলাকায় বিল্ডিং কোডের তোয়াক্কা না করে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। সিটি করপেরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চলছে এই প্রতিযোগিতা। এর ফলে ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেটে ঝুঁকি বাড়ছেই। ভবন মালিকদের ভাষ্য, তারা সিটি করপোরেশনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ভবন নির্মাণ করছেন। অন্যদিকে ভবন মালিকদের সাথে সিসিকের দ্বৈত আচরণের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সিসিকের এমন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে ভবন মালিক।
এ নিয়ে সচেতন নাগরিকদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করে মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ জীবননাশের হুমকির শিকার হয়েছেন। এ রকম অবস্থায় যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই নির্মাণ করছেন বহুতল ভবন। সিলেট সিটি করপোরেশনের এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে এমন অভিযোগ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেট নগরীতে এভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিল্ডিং কোড মেনে জায়গা ছাড়া তো পরের কথা উল্টো অনেক এলাকায় ভবন ঘেঁষে একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখার অনিয়মের বেশকিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
দক্ষিণ সুরমার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাঠান পাড়া আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. বাছিত মিয়া জানান, সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা থেকে তিনি একটি নোটিশ পেয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে তিনি নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ করেছেন। এমতাবস্থায় তাকে বিধি বহির্ভূত অংশ এবং ৫ম তলার নির্মাণাধীন অংশ অপসারণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছ। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ইতোমধ্যে সেই চিঠির লিখিত জবাবও দিয়েছেন মো. বাছিত মিয়া। তার দাবি, ২০১৫ সালে তিনি সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়েই ভবন নির্মাণ করেছেন। সেই অনুমোদনের একটি কপি ঢাকা জার্নালের কাছে সংরক্ষিত আছে।
ওই কপি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখ মো. বছিত মিয়াকে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাঠান পাড়া আবাসিক এলাকার ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা। অনুমোদন পত্রে বলা হয় একই বছরের ৯ আগস্ট তার (বাছিত মিয়া) আবেদনের প্রেক্ষিতে 'সোনালী ব্যাংক চালান নং-২৫৩০, ফিস দশ হাজার প্রস্তাবিত নির্মাণ/খনন কার্যের জন্য অনুমোন করা হলো।' অনুমোদন পত্রে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌলশীর স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়াও সিটি করপোরেশনের নিজস্ব প্রকৌশলী কতৃক অনুমোদিত নক্সা সংযুক্ত আছে; প্রশ্ন হলো অনুমোদিত ভবন ভাঙার নির্দেশ কেন দিল সিটি করপেরেশন।
সরজমিনে দেখা গেছে, যে যায়গায় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে রাস্তা সরজমিনে আছে মাত্র ৮ ফুট। অথচ ভবনের নক্সায় রাস্তা দেখানো হয়েছে ১২ ফুট। আসল গলদ এইখানে। সিসিকের আইন বলছে নগরীতে ১০ তলার ওপরে ভবন নির্মাণে সম্মুখভাগে ২০ ফুট থেকে ৪০ ফুট রাস্তা থাকতে হবে। ৫ তলা ভবনের ক্ষেত্রে মালিককে সামনের দিকে ১২ ফুট রাস্তা ছেড়ে ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছ। 'সেখানে মাত্র ৮ ফুট রাস্তায় মো. বাছিত মিয়ার বভনের অনুমোদন হলো কি করে।'
ভবন মালিকের ভাই সালমান অভিযোগ করে তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশন বলছে আমি নিয়ম ভঙ্গ করেছি। তাহলে তারা আমার ফাইলে অনুমোদন দিল কীভাবে? অথচ আমার পার্শ্ববর্তী অনেকে ৮ ফুট রাস্তা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করেছেন। এরকম আরো ৮টি ভবন একইভাবে নির্মিত হয়েছে। কই তাদের বেলায় তো সিটি কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখলাম না।'
স্থানীয় সূত্র জানায়, সিলেট মহানগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পঠান পাড়া আবাসিক এলাকায় প্রভাবশালীরা বিল্ডিং কোডের তোয়াক্কা না করেই নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন। অভিযোগ সিটি করপোরেশন থেকে ৩ তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে অনেকে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করছেন। কেউ কেউ ওয়ার্ডের প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে সরু ৮ ফুটের রাস্তা কাগজে ১২ ফুট দেখিয়ে অনুমোদন নিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাঠান পাড়া আবাসিক এলাকায় অন্তত ৮টি ভবন বিল্ডিং কোডের তোয়াক্কা না করেই নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জলিল খাঁন, মুজস্তদির খাঁন, গুলজার খাঁন, এখতিয়ার খাঁন, নাসির খাঁন, দিলদার খাঁন, দিলওয়ার খাঁন, নাজির খাাঁন। তারাও মো. বাছিত মিয়ার মতো ৮ রাস্তা ১২ ফুট দেখিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকা জার্নালকে জানান, "ভূমিকম্প প্রবণ সিলেটে বিল্ডিং কোড না মেনে গায়ের জোরে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভবন মালিক ও ডেভেলপ ব্যবসায়ীদের বহুতল ভবন নির্মাণ আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি এ নিয়ে সিটি করপোরেশন র্কর্তৃপক্ষের জোরালো কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখতে চান।"
সিটি করপোরেশনের (সিসিক) প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি ঢাকা জার্নালকে বলেন, "যখনই কোনো অভিযোগ কিংবা নিয়ম ভেঙে ভবন নির্মাণের খবর আসছে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ৮ ফুটের রাস্তা কগজে ১২ হলো কী করে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, তথ্য গোপন করে হয়তো করা হয়েছে। আপনারা অনুমোদন দিলেন কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমাদের লোক টাকাটুকা খেয়ে হয়তো এই কাজ করেছে।"
তিনি আরও বলেন, "এই ক্ষেত্রে ভবন মালিক ও ডেভেলপারদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধানের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।ইতোমধ্যে অভিযোগ পাওয়া বেশকিছু ভবন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাসহ ভবনের অননুমোদিত অংশ ভাঙা হয়েছে।"
Comments