নীরব নায়কের গল্প-১

শহরের কোলাহলের গণ্ডি পেরিয়ে, সবুজে মোড়া ছোট্ট এক বাসা। সেই ঘরের জানালার পাশে বসে, বিকেলের রোদে সোনালি আকাশ পেরিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিদের দেখত অর্ণা। মনে হতো, পাখিরা ভুল ডালে বসলেও, ডানা মেলে উড়ে যেতে জানে। অথচ মানুষ? ভুল করলে সে শুধু নিচে পরে যায়, আর খুব কম মানুষই ডানার মতো সাহস জোগাড় করে ফিরতে পারে।
রায়হান ছিল এক স্বপ্ন দেখা যুবক। একুশের এক বইমেলায় বইয়ের পাতার গন্ধে, শীতের সকালে, ভিড়ের ভেতর পরিচয় হয়েছিল ওদের। সীমিত আয়ের হিসেবি জীবন, মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধ আর অর্ণার সাথে ভাগ করে নেয়া ছোট্ট সুখ, সব ছিল ভালোবাসা আর পরিশ্রমের নিঃশব্দ সমীকরণে বাঁধা।
রায়হানের সেই কথাগুলো এখনো অর্ণার হৃদয়ে শব্দের মতো বাজে 'শর্টকাট দিয়ে বড় হওয়া যায়, মানুষ হওয়া যায় না। আমি সময় নেব, ধীরে হাঁটব, তবুও নিজের পথে থাকব'।
কিন্তু জীবন তো কবিতার মতো সহজ সরল ছন্দে চলে না। এক দুর্ঘটনায় রায়হান হারাল তার বড় ভাইকে। কিছুদিনের ব্যবধানে নিভে গেল মায়ের জীবনপ্রদীপও। পৃথিবীর সব রঙ যেন মুহূর্তেই ফিকে হয়ে গেল রায়হানের কাছে। দুঃখের ভার থেকে পালাতে, রাতের পর রাত শহরের অলিতে-গলিতে, বন্ধুদের হাসির ভিড়ে, অপরিচিত মুখের পরিচয়ে নিজেকে খুঁজে ফিরল সে। ভুল ডালে পা দিল পাখির মতো, ভাবল উড়েই পালিয়ে যাবে সব থেকে।
কিন্তু মানুষ তো পাখি নয়। ডানা নেই, পালাবার ক্ষমতাও সীমিত। ভুলের ডাল ভেঙে গেলে, সোজা মাটিতে পরতে হয়।
রায়হানও একদিন পরলো। সম্পর্কের ভিত কেঁপে উঠল, ভালোবাসার সুতোর গাঁথুনি আলগা হয়ে গেল।
এক রাতে, নিঃশব্দ ফোনের আলোয়, অর্ণা দেখে ফেলল এক অপরিচিত নাম।
নিঃশব্দেই বলে ফেলা হয়ে গেল সম্পর্কের শেষ অধ্যায়।
'তুমি কি তাকে ভালোবাসো?' — কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিল অর্ণা।
রায়হান কোন নাটক না করে শান্তভাবে বলেছিল,
'কালই চলে যাবো'।
পাখিরা ভুল করলে উড়ে যায়, কিন্তু মানুষ? মানুষ হারিয়ে যায়। সেদিন রায়হানও হারাল — এক নীরব নায়ক হয়ে।
বছর দুয়েক পর, এক অলস বিকেলে, পত্রিকার পাতায় অর্ণা দেখল — রায়হান এখন এক নামকরা লেখক। তার আত্মজীবনীতে স্পষ্ট বাক্য —
'নিজের ভুল থেকেই শিখেছি'।
আকাশের দিকে তাকিয়ে, অর্ণা হালকা হাসিতে ফিসফিস করে বলল,
'পাখিরা ভুল ডাল বদলে উড়ে যায়, আর মানুষ? মানুষ ডানাহীন। তোমার পক্ষে ডানা মেলা সম্ভব হয়েছিল, রায়হান। হয়তো সফল হয়েছো, কিন্তু নায়ক হতে শুধু ডানা নয়, হৃদয় লাগে। তুমি উড়ে গিয়েছো, কিন্তু ফেলে গেছো এক ভাঙা গল্প'।
সেই সন্ধ্যায়, বৃষ্টির টুপটাপ শব্দের ভেতর, অর্ণা বুঝে গেল —
পাখি উড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু মানুষের ফেলে যাওয়া গল্পগুলো থেকে যায় — নিঃশব্দ, অথচ অসীম দীর্ঘ।
Comments