সরকারি ঋণের চাপ ও বেসরকারি বিনিয়োগে খরা
ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। মাত্র ১৪ দিনের ব্যবধানে এই ঋণ ৩৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা অর্থনীতির ভেতরের চাপেরই প্রতিফলন। নির্বাচনসংক্রান্ত ব্যয় এবং পাঁচটি ব্যাংকের মূলধন সহায়তায় অর্থ ছাড় -এই দুই কারণকে সামনে আনা হলেও বাস্তবে এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে পুরো আর্থিক ব্যবস্থার ওপর।
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের শুরু থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের ব্যাংকঋণ ছিল সীমিত। কারণ উন্নয়ন ব্যয় কার্যত স্থবির ছিল। কিন্তু পরবর্তী দুই সপ্তাহেই দৃশ্যপট বদলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১.০৪ লাখ কোটি টাকার বিপরীতে ইতোমধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ ঋণ নেওয়া হয়ে গেছে।
এই ঋণ প্রবণতা অর্থনীতির জন্য দ্বিমুখী ঝুঁকি তৈরি করছে। একদিকে সরকারের স্বল্পমেয়াদি ব্যয়ের চাপ মেটানো হলেও অন্যদিকে বেসরকারি খাত কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ চাহিদা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান সংকুচিত হয়, যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় 'ক্রাউডিং আউট' প্রভাব।
এর ফল ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬.২৩ শতাংশে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৬.২৯ শতাংশ। এই সামান্য পতন সংখ্যায় ছোট হলেও এর ভেতরের বার্তাটি বড়ো, দেশের বিনিয়োগচাকা কার্যত থমকে যাচ্ছে।
বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মূল কারণ নতুন বিনিয়োগের দুর্বলতা। বিনিয়োগ না হলে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও কমে যায়, আর তখন ব্যাংকঋণের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পায়। চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি প্রায় ৯.৫ শতাংশ কমে যাওয়াই তার প্রমাণ। অর্থাৎ শিল্পকারখানা সম্প্রসারণ বা নতুন উদ্যোগ নেওয়ার কোনো দৃশ্যমান প্রস্তুতি অর্থনীতিতে নেই।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বেসরকারি ঋণের মন্থরগতি শুধু চাহিদাজনিত নয়, জোগানজনিতও। চাহিদার দিক থেকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে তুলেছে। তারা অপেক্ষা করছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার। অন্যদিকে, ব্যাংকগুলোর বড়ো অংশের তারল্য সরকারের ঋণ মেটাতেই ব্যস্ত থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও সীমিত হয়ে পড়ছে।
অনেকে আশা করছেন, জাতীয় নির্বাচনের পর বিনিয়োগ পরিস্থিতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবতা এত সহজ নয়। অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচনের পর বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হতে দেড় বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নীতির ধারাবাহিকতা এবং প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা -এই তিনটি বিষয়ে আস্থা ফিরে না এলে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকবেন না।
সুতরাং প্রশ্নটি এখন কেবল সরকারের ঋণ নেওয়া নয়, বরং ঋণের গুণগত ব্যবহার ও এর সময়োপযোগিতা। উন্নয়ন ব্যয় কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না করে যদি কেবল চলতি ব্যয় ও ব্যাংক উদ্ধারেই ঋণ ব্যয় হয়, তবে তার চাপ বহন করতে হবে বেসরকারি খাতকে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ দুর্বল হলে কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রাজস্ব - সবই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
অর্থনীতির এই জটিল সময়ে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংকিং খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনা। তা না হলে সরকারি ঋণের স্বস্তি খুব দ্রুতই সামগ্রিক অর্থনীতিতে বোঝায় পরিণত হবে।
Comments