শেষ হলো ঐক্যমত্য কমিশনের মেয়াদ, অর্জন কী?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের শেষ বৈঠক হয়েছে গতকাল সোমবার। কমিশনের মেয়াদ অবশ্য আছে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। মঙ্গলবার সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ দিয়েছে কমিশন।
মাসের পর মাস, বৈঠকের পর বৈঠক করে এই কমিশন নিজে কি অর্জন করল, জাতিকে কি উপহার দিল সে প্রশ্ন উঠেছে।
বলতে গেলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ রেখেই দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
প্রশ্ন উঠেছে, এই ঐক্যমত্য কমিশন কি তবে ঐক্যের বদলে বিভাজন আরও বাড়ালো? জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। কমিশন ঐকমত্য নামে তৈরি হলেও, তাদের সুপারিশ দেশকে অনৈক্য ও বিভেদের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলছেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ অভিযোগ করে বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটা চেষ্টা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে,সেই স্বাক্ষরিত সনদবহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,বিস্ময়করভাবে যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হলো সুপারিশমালার সঙ্গে,সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই।
বিভেদই যদি শেষ পর্যন্ত পরিণতি হয়, তাহলে বলতেই হবে যে, অতি দীর্ঘ সময় নিয়ে, অসংখ্য মিটিং করে, রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশ নিয়ে যে কাজ করার উদ্দেশ্য ছিল কমিশনের তা অর্থহীন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। আর এতে করে দেশে নতুন করে সংঘাতময় রাজনীতির পরিবেশ ফিরে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
যে জায়গায় ঐক্যমত কমিশন বেশি জোর দিয়েছে, তা হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি। অথচ এটি কমিশনের কর্মপরিধির মধ্যেই নেই। কমিশনের যে কাজটা জোর দিয়ে করা উচিত ছিল তা হলো – ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রস্তাবনা তৈরি করা এবং সে অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিসরে ঐক্যের পরিবেশ তৈরি করা।
কমিশন বলেছে, নির্বাচনের পরে ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করা হবে। গণভোটের ম্যান্ডেটের পরও সেই সংসদ যদি এই সংশোধনীগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়,তাহলে ৯ মাসের মাথায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। এরকম বিধান গণতন্ত্রের ওপর আগাম সিদ্ধিন্ত চাপিয়ে দেওয়ার শামিল। যারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন তারা সিদ্ধান্ত নেবেন সংবিধানে কী তারা সংযোজন বা বিয়োজন করবেন। এটি বিজয়ী দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কমিশন কেমন করে ভাবল যে, আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সবকিছু করিয়ে ফেলা যায়, সেটাই সবার কাছে বিস্ময়কর লাগছে।
রাষ্ট্রের মূল কাঠামো নিয়ে অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দীর্ঘ মেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে। ঐক্যমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা না করা দলগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গণভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ মেটানোর চেষ্টা আসলে রাজনীতির ওপর অরাজনৈতিক খবরদারি।
কমিশনের পক্ষপাতিত্বও স্পষ্ট। ঐকমত্য কমিশন বলছে, যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে, তার ওপরই গণভোট হবে। গণভোটে 'হ্যাঁ' জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সনদ স্বাক্ষর না করা এনসিপির সম্মতি এই শেষ সময়ে নিশ্চিত করতে তাদের দেওয়া শর্ত মেনেই এমন প্রস্তাব করেছে কমিশন।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ঐক্যমত্য কমিশন কি চালাকিরও আশ্রয় নিয়েছে? জমা দেওয়া রিপোর্টে যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হয়েছে সুপারিশমালার সঙ্গে,সেখানে নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট থাকতেই পারে। এসব কারও কাছে যৌক্তিক বা কারও কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এসব মাথায় রেখেও কোনো দল যদি ভিন্নমত প্রকাশ করে,তবে তাকে সম্মান জানাবে না ঐক্যমত্য কমিশন?
যেভাবে গণভোটকেই ত্রাতা মনে করা হচ্ছে তাতে প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন মাসের পর মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতি দীর্ঘ আলোচনা করা হলো? কেন জনগণের অর্থ এমনভাবে খরচ করা হলো? কমিশন সদস্যরা টেবিলে বসে একটা রিপোর্ট তৈরি করে দিয়ে দিলেই পারতেন!
একটি বড় দল হিসেবে, গণভোট হওয়াটা যদি বিএনপি গ্রহণ না করে এবং এর বিরুদ্ধে মাঠে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় – সেই পরিস্থিতিতে রাজনীতি কোন পথে যাবে সেটা কি কমিশন ভেবে দেখেছে?
সাম্প্রতিক সময় দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমতো সরকার গণভোটের আয়োজন করতে গেলে অনিবার্যভাবেই দেশে রাজনৈতিক অনৈক্য, এমনকি সংঘাত তৈরির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। দুঃখের সাথে বলতে হয়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তৈরি হয়েছিল সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মোটা দাগে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে। দীর্ঘ সময় ধরে এত এত বৈঠক করে শেষ সময়ে এসে গণভোট প্রশ্নে এমন একটা অবস্থান নিল যা কমিশন শুধু নয়, এর সম্মানিত সদস্যদের প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
Comments