অর্থ বছরের শেষ সময়ে এনবিআর-এ আন্দোলন, রাজস্ব আহরণে অচলাবস্থা

বাজেটের ঠিক আগে আগে যেভাবে কর্মীদের আন্দোলনে অচল হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), তা এক কথায় নজিরবিহীন। গত ১৩ মে 'মধ্যরাতের অধ্যাদেশ' দিয়ে এনবিআর বিলুপ্তের যে প্রজ্ঞাপন হয়েছে সেখান থেকেই সংকটের শুরু। সকালবেলা অধ্যাদেশ সম্পর্কে জানতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সর্বস্তরের কর্মকর্তারা। আন্দোলনরত কর্মকর্তারা গত বুধবার প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের অপসারণ চেয়ে লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন।
অধ্যাদেশে এনবিআর ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজস্ব খাত এখন থেকে 'রাজস্ব নীতি বিভাগ'ও 'রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ'- এই দুই ভাগে পরিচালিত হবে। অধ্যাদেশে শুধু রাজস্ব নীতি বিভাগের রাজস্ব কর্মকর্তারা কার্যপরিধিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
এই অধ্যাদেশের প্রতিবাদে এনবিআরের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে গঠিত হয় 'এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ', যাতে রাজস্ব বিভাগের সব স্তরের কর্মচারীরা একত্রিত হন। তাদের অভিযোগ, এই অধ্যাদেশের লক্ষ্য এনবিআরকে স্থায়ীভাবে প্রশাসন ক্যাডারের অধীনে নিয়ে যাওয়া। কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনার স্বাধীনতা নিশ্চিত না করে বরং এনবিআরের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রশাসন ক্যাডারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন কাঠামোয় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে প্রশাসন ক্যাডারের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাজ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে রাজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এসব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্বই বেশি থাকবে। কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তারা মনে করছেন প্রশাসন থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। আমলারা যেহেতু কর আইন গুলো সম্পর্কে ধারণা রাখেন না সেক্ষেত্রে যে কোনো নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে। এতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয়েও তার নীতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অধ্যাদেশে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা-এই দুই বিভাগেই প্রধান হিসেবে রাজস্ব ক্যাডার বহির্ভূত প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পাশাপাশি গঠিতব্য বিভাগ দুটির বিভিন্ন পদ পূরণেও প্রশাসন ক্যাডার থেকে জনবল নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। রাজস্ব নীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ দেবে। অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব আহরণ সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যোগ্য সরকারি কর্মচারীকে সচিব বা সিনিয়র সচিব পদে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ ছাড়া উভয় বিভাগে বিভিন্ন পদেও প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
এই অধ্যাদেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে এনবিআরের বাইরেও। যেভাবে এনবিআরকে দুই ভাগ করা হয়েছে তার সমালোচনা আসছে সুশীল সমাজ থেকেও। বহুদিন ধরেই এনবিআরের নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ আলাদা করার কথা আলোচনায় ছিল। কিন্তু যেভাবে করা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অংশীজনদের সাথে আলোচনা ছাড়া পেশাজীবীদের জায়গাকে সংকুচিত করে এবং অন্যান্য স্বায়ত্তশাসনের জায়গাকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণে রেখে যেভাবে ভাগ করা হয়েছে, এই পদ্ধতি ঠিক হয়নি।
বিষয়টাকে শুধু আন্ত:ক্যাডার সার্ভিসের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখলে সমস্যার সমাধান হবে না। মনে রাখা দরকার, এই সংস্কারের লক্ষ্য কর নীতিকে কর আহরণ প্রথা থেকে আলাদা করা, স্ব স্ব বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব পরিহার করা এবং কর দাতাদের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করা।
সব মহল থেকে যখন আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার কথা বলছেন, তখন সরকারকে অধ্যাদেশের পক্ষে অনমনীয় বলেই মনে হচ্ছে। গত ২০ মে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন,'জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে যেভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে,তা বহাল থাকবে। এ নিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল,তা দূর হয়েছে।'
কিন্তু আসলে কিছুই দূর হয়নি। এখন কর্মকর্তারা বলছেন চার দফা দাবিতে তাদের আন্দোলন চলবে। এই দাবিগুলো হলো, জারি করা অধ্যাদেশ অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে; অবিলম্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে; রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে; জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়া এবং পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতাসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের মতামত নিয়ে উপযুক্ত ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। একই দিন এনবিআর ভবনসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। পরবর্তী কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৪, ২৫ ও ২৬ মে-তিন দিনব্যাপী পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে।
এ অবস্থায় রাজস্ব আদায় ও ব্যবস্থাপনা সংকটে পড়েছে। সব সময়ই অর্থবছরের শেষ সময়ে রাজস্ব আদায় বাড়ে। এবার এনবিআরে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন ঘিরে এ অবস্থা হয়েছে। আগের ২০ দিনের মতো এই গতিতে রাজস্ব আদায় হলে মে মাসে রাজস্ব আদায় হতে পারে ১৫/১৬ হাজার কোটি টাকা। এতে রাজস্ব আদায়ের ধস নামবে। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
Comments