প্রেমে ব্যর্থ হয়ে যেভাবে ধর্মের পথে পা বাড়ান পোপ ফ্রান্সিস

ইউরোপেীয় সময় সকাল সাড়ে সাতটা আর বাংলাদেশ সময় দুপুর থেকেই সারা বিশ্বের প্রধান খবর হয়ে যায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
জীবনের শুরুতে ধর্মের আশপাশেও ছিলেন না তিনি। ছিলেন রসায়ন প্রযুক্তির শিক্ষার্থী। নামও ছিল ভিন্ন—হোর্গে মারিও বারগোগ্লিও। ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সের ফ্লোরেসে জন্মগ্রহণ করেন হোর্গে মারিও বারগোগ্লিও। রেলের কর্মী বাবা হোসে মারিও বারগোগ্লিও এবং গৃহিণী মা রেগিনা মারিয়া সিভোরির পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন হোর্গে। পরিবারটি ছিল ইতালীয় অভিবাসী, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসনামলে পালিয়ে তারা আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেন।
শৈশব ও প্রাথমিক জীবন
শৈশবে খুবই সাধারণ পারিবারিক আবহে বড় হয়ে ওঠেন হোর্গে, যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতার প্রভাব তার ব্যক্তিত্ব গঠন করে। বুয়েনস এইরেসের রামোস মেহিয়া শহরে অবস্থিত উইলফ্রেদ বারন দে লস সানতোস আনহেলেস স্কুলে শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক পাঠ নেন তিনি। পরবর্তীতে এসকেলা তেকনিকা নাসিওনাল (ন্যাশনাল টেকনিকাল স্কুল) থেকে রসায়ন প্রযুক্তিবিদ হিসেবে ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন হোর্গে। একটি খাদ্য পরীক্ষাগারে রসায়নবিদ হিসেবে কাজ করেছেন, এমনকি নাইটক্লাবের নিরাপত্তারক্ষী ও ঝাড়ুদার হিসেবেও কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার। এসব অভিজ্ঞতা তার জীবনদর্শন গঠনে সাহায্য করে। বিশেষ করে সমাজের শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও কর্ম কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়ায় পরবর্তী জীবনে এসব অভিজ্ঞতা এই শ্রেণির মানুষের প্রতি তার সহানুভূতি এবং দরিদ্রদের প্রতি দায়বদ্ধতার মনোভাব তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলে। এছাড়া সঙ্গীত, ফুটবল ও ট্যাঙ্গো নাচের প্রতি আকর্ষণ তার ব্যক্তিত্বে যোগ করে গভীর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।

কৈশোরের প্রেম ও যাজক হওয়ার পথে যাত্রা
শৈশবে আমালিয়া দামোন্তে নামের এক কিশোরীর সংস্পর্শে আসেন হোর্গে। তাদের বাড়ি থেকে মাত্র চার ঘর দূরত্বের বাসিন্দা এই প্রতিবেশীনীর প্রতি একসময় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। তার জীবনের গল্প থেকে জানা যায়, ১২ বছর বয়সে আমালিয়াকে একটি প্রেমপত্র লেখেন হোর্গে। চিঠিতে তিনি ভবিষ্যতে আমালিয়াকে নিয়ে সংসার গড়ার পরিকল্পনার কথাও জানান। তিনি আরও লেখেন, 'যদি তুমি আমাকে বিয়ে না কর, তাহলে আমি ধর্মযাজক হয়ে যাব।'
ওই চিঠি পড়ে আমালিয়ার বাবা-মায়ের হাতে। তারা এই সম্পর্ক মেনে নেননি। আমালিয়ার অভিভাবকরা সম্পর্কটিকে কৈশোরের উন্মাদনা হিসেবে দেখে উড়িয়ে দেন। একপর্যায়ে মেয়ের হোর্গের সঙ্গে দেখা করাও বন্ধ করে দেন তারা।
আমালিয়া পরে জানিয়েছিলেন, 'আমরা রাস্তায়, পার্কে একসঙ্গে হাঁটতাম, খেলতাম, নাচতাম। হোর্গে চমৎকার ছেলে ছিল। ওই বয়সেও সে ছিল যথেষ্ট পরিণত।' তবে পরিবারের বাধায় সম্পর্কটি বেশিদূর এগোয়নি বলে স্বীকার করেন তিনিও।
প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন হোর্গে বারগোগ্লিও। ধর্মযাজক হওয়ার পথই বেছে নেন তিনি।
যাজক হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে আরও একবার প্রেমে পড়েন পরবর্তী জীবনে সর্বজন সমাদৃত এই ধর্মীয় নেতা।
এ বিষয়ে ২০১৪ সালে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমি যখন সেমিনারিতে (ধর্মযাজক হওয়ার প্রশিক্ষণে) ছিলাম, বয়স ২২ কি ২৩ হবে, তখন একটি মেয়ে আমার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। তার আকর্ষণ এতই তীব্র ছিল যে, আমি প্রশিক্ষণে মন বসাতে পারছিলাম না। শেষমেষ আমাকে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে কনফেসরের (ধর্মীয় উপদেষ্টা) কাছে যেতে হয়।'
মজা করে তিনি বলেছিলেন, তবে সেই প্রেম টিকেছিল মাত্র এক সপ্তাহ। কনফেসরের উপদেশ মাথায় নিয়ে ফের ঈশ্বরের সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
আরও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও তিনি একবার বলেছিলেন। ২০১০ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ট্যাঙ্গো নাচার সময় বন্ধুদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল, যার প্রতি তিনি টান অনুভব করেন। তবে মূলত সেই সময়েই তিনি নিজের মধ্যে ঈশ্বরের আহ্বান আবিষ্কার করেন বলে জানান।
হোর্গে বার্গোগ্লিওর প্রেমের অভিজ্ঞতাগুলো তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। আমালিয়া দামোন্তের সঙ্গে শৈশবের প্রেম এবং যৌবনে সেমিনারিতে ওই মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ তাকে মানুষের সম্পর্ক ও ভালোবাসার জটিলতা সম্পর্কে শিখিয়েছিল। এই অভিজ্ঞতাগুলো তার ধর্মীয় আহ্বানকে আরও দৃঢ় করে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন যে, জীবনের উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের সেবা করা এবং মানুষের মাঝে তাঁর বাণী পৌঁছে দেওয়া।

ধর্মের পথে যাত্রা
১৯৫৩ সালে ১৬/১৭ বছর বয়সে ফ্লোরেসের একটি গির্জায় কনফেশনের (পাপ স্বীকারের) জন্য যান হোর্গে। সময়টি ছিল গাউদেতে সানডে, অ্যাডভেন্টের তৃতীয় রবিবার; খ্রিস্টানরা দিনটিকে আনন্দের দিন হিসেবে পালন করে থাকেন।
গির্জায় একজন যাজক কিশোর হোর্গেকে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানান, যাতে তার হৃদয় আন্দোলিত হয়। ওই যাজকের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার সম্পর্ক বাড়তে থাকে। যাজকের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তার জীবনে আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটে। তিনি অনুভব করেন যে, ঈশ্বর তাকে ডাকছেন।
তবে ধর্মের পথে তার এই যাত্রার শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। ছেলের এই সিদ্ধান্তের কঠোর বিরোধিতা করেন মা। তিনি চাইতেন যে, তার ছেলে আর দশটা ছেলের মতোই সাধারণ জীবনযাপন করুক। বিয়ে করে সংসারী হোক। তবে ছেলের অনড় সিদ্ধান্তের কাছে একসময় হার মানেন ক্যাথলিক মা।
১৯৫৮ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি জেসুইট সোসাইটি অফ জিসাসে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৩৩ বছর বয়সে যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন হোর্গে বার্গোগ্লিও। আর্জেন্টিনার কর্দোবার আর্চবিশপ রামন হোসে কাস্তেয়ানোর মাধ্যমে তিনি অভিষিক্ত হন। এরপর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় জেসুইটদের প্রাদেশিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই সময়ে আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসন চলছিল, ইতিহাসের পাতায় যা 'ডার্টি ওয়ার' বা নোংরা যুদ্ধ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
বৈরি পরিবেশেও তিনি ধর্মযাজকসহ অন্যান্যদের নিরাপত্তায় গোপনে কাজ করে যান। তাকে দমন করতে সে সময় তার বিরুদ্ধে কিছু বিতর্কিত অভিযোগও তোলা হয়। তবে নিজের দায়িত্বে তিনি ছিলেন অটল। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শান্ত হওয়ার পর অবশ্য সেসব অভিযোগ মিথ্যা বলে খারিজ হয়।
১৯৯২ সালে তিনি বুয়েনস এইরেসের সহকারী বিশপ নিযুক্ত হন। ১৯৯৮ সালে হন আর্চবিশপ। এরপর ২০০১ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল তাকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন।
আর্চবিশপ হিসেবে বুয়েনস এইরেসের বস্তিবাসীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন হোর্গে। সাধারণ জীবনযাপন, বাসে চলাফেরা ও নিজের খাবার রান্না করার মতো কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে বেশি সময় লাগে না তার। 'বস্তির বিশপ' হিসেবে এ সময় পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।
পোপ হিসেবে অভিষেক ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব
বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে নতুন পোপ নির্বাচিত হন বার্গোগ্লিও। দিনটি ছিল সে বছরের ১৩ মার্চ।
পোপ হিসেবে অভিষেকের পর নতুন নাম গ্রহণ করেন হোর্গে—পো ফ্রান্সিস। ইতালির আসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসের সম্মানে তিনি এই নাম গ্রহণ করেন। দারিদ্র্য বিমোচন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউরোপের প্রখ্যাত সাধু ছিলেন সেন্ট ফ্রান্সিস অব অ্যাসিসি।
পোপ হওয়ার পর ফ্রান্সিসও সাদামাটা জীবন বেছে নেন। ভ্যাটিকানের বিলাসবহুল আবাসনের পরিবর্তে কাসা সান্তা মার্তায় সাধারণ পরিবেশে বসবাস শুরু করেন তিনি। তাছাড়া মাঝেমধ্যেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের মন জয় করে নেন।
তিনি দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ। দায়িত্ব পালনকালে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং আন্তঃধর্মীয় ঐক্য ও সংলাপের মতো বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেন।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ সফর করেন পোপ। সে সময় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে তাদের অধিকারের জন্যেও আওয়াজ তোলেন তিনি।

সংস্কার ও বিতর্ক
পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানের প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কারের চেষ্টা করেন। সমকামিতা ও বিবাহবিচ্ছেদের মতো বিষয়ে উদারনীতি অবলম্বন করে ভাঙেন ক্যাথলিক চার্চের ঐতিহ্য। এর ফলে রক্ষণশীল খ্রিষ্টানদের সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় তাকে। তবে গৃহীত সিদ্ধান্তের সপক্ষে তার ভাষ্য ছিল, 'একজন সমকামী ব্যক্তি যদি ঈশ্বরের সন্ধান করেন, তবে আমি তাকে বিচার করার কে?'
সমলিঙ্গের যুগলদের আশীর্বাদ করতে রোমান ক্যাথলিক যাজকদের অনুমতি দিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। এছাড়া ধর্মযাজকের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের এবং কানাডার আদিবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চেয়ে তিনি আলোচনার জন্ম দেন।
তিনি বলেছিলেন, ক্যাথলিক গির্জার দরজা সবার জন্য খোলা। এমনকি সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামীদেরও (এলজিবিটি) গির্জায় আসতে বাধা নেই। তারা গির্জায় এসে প্রার্থনা করতে পারবেন, তবে গির্জার নিয়মনীতি তাদের মেনে চলতে হবে।
স্বীকৃতি
পোপ ফ্রান্সিসের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তাকে বিশ্বব্যাপী বিরল সম্মানের আসনে আসীন করে। ২০১৩ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে 'বর্ষসেরা ব্যক্তি' ঘোষণা করে। ভ্যানিটি ফেয়ার তাকে 'সাহসী পোপ' হিসেবে আখ্যায়িত করে। নম্রতা, গরীবের প্রতি ভালোবাসা ও পরিবেশ সচেতনতার জন্য সারা বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসেন এই ধর্মযাজক।
তার 'সিনডাল চার্চের' ধারণা, যেখানে সাধারণ মানুষের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়, ক্যাথলিক চার্চের গঠনপ্রণালীতে একটি নতুন পথ প্রদর্শন করেছে। এই ধারণা প্রতিষ্ঠায় তিনি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অ্যামাজন অঞ্চলের মানুষদের নিয়েও সিনড আয়োজন করেন।
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনের গল্প অনন্য। একজন সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্বের আধ্যাত্মিক নেতা হয়ে ওঠার অসাধারণ এক যাত্রার গল্প। তার নম্রতা, গরীবের প্রতি সহানুভূতি ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার আজীবনের প্রচেষ্টা বৈশ্বিক ধর্মীয় পরিসরে একটি বিশেষ যুগের সৃষ্টি করেছে।
প্রয়াণ-ক্ষণে তার জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। তার মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে সেবা, সহানুভূতি ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বিশ্বকে আরও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার শপথ নিতে পারি আমরা।
ইউএনবি
Comments