বাঁচতে হলে জানতে হবে- অনুভূতির ইঞ্জিনিয়ারিং
আজ আমরা যে বিষয় নিয়ে কথা বলব, সেটা আসলে আমাদের সবার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আমাদের চারপাশের কাছের মানুষগুলো মাঝে মাঝে আমাদের সাথে এই ধরনের আচরণ করে। আমরাও হয়তোবা না জেনেই এই ধরনের আচরণ করে আশপাশের মানুষদেরকে মানসিকভাবে যন্ত্রণা দেই।
'মানুষের মন নিয়ে খেলা করতে নেই' - এই আদর্শ বাক্য ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি আমরা। কিন্তু কমবেশি সবাই আমরা এই কাজটা করি। মানে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করি এবং যদি উদ্দেশ্য সফল হয় তাতে এক ধরনের আনন্দ লাভ করি। আলোচনার বিষয় হচ্ছে, মনস্তাত্ত্বিক কারসাজি, ইংরেজিতে যাকে বলে সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন। আমরা মানুষের এই ধরনের কাজগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করব এবং ১৪ টি প্যাটার্ন (ধরন) নিয়ে আলোচনা করব। চেষ্টা করব, সঠিক উত্তর কীভাবে দিতে হবে, কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেই বিষয়ে একটা গাইডলাইন (নির্দেশিকা) দেওয়া। কিন্তু প্রত্যেকের জীবন আলাদা এবং পরিস্থিতি ইউনিক (অনন্য)। তাই আমাদের নিজেকেই সঠিক উত্তরটা বের করতে হবে; আমি কেবল তাত্ত্বিক আলোচনা করব।
১। অপরাধবোধ তৈরি করা (Guilt Tripping)
এই কাজটা কাছের মানুষরা সবচেয়ে বেশি করে। আমি অবশ্যই কোনো জেন্ডার বায়াস (লিঙ্গ বৈষম্য) করব না। কারণ ছেলে-মেয়ে সবার এই ধরনের আচরণ করার রেকর্ড (প্রমাণ) আছে। সারা সপ্তাহ খুব কাজের চাপ (প্রেসার)। অতিরিক্ত পরিশ্রম করার পরে আপনি আপনার প্রিয়জনের খোঁজ একবারেই নিতে পারেননি ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু মনে মনে আপনি তাকে খুব মিস করছিলেন। একটু সময় হাতে এলো, দম ফেলার সময় ভাবলেন, একটু প্রিয়জনের সাথে কথা বলে মনটা হালকা করা যায়, তাকে যে আপনি খুব মিস করছেন সে কথা বলতেই ফোন দিলেন। ফোন করা মাত্র অপর দিক থেকে ভেসে এলো অভিযোগ। 'আমার সাথে কথা বলার জন্য তোমার পাঁচ মিনিট সময়ও হয় না, তাই না? এতক্ষণে সময় হলো আমার খোঁজ নেওয়ার? বেঁচে আছি না মারা গেছি, সেটা জেনে নিচ্ছ, তাই না?'
সাথে সাথে আপনি শুরু করলেন ক্ষমা চাওয়া। তাকে যে মিস করছিলেন সেটা বলার সুযোগই পেলেন না। কোথায় একটু দম ফেলার জন্য, একটু শান্তির জন্য ফোন দিয়েছিলেন, কিন্তু আপনার এখন ক্ষমা চাইতে চাইতে সময় শেষ। এই ধরনের পরিস্থিতিতে উঠতি বয়সে পড়েনি এমন মানুষ কম। অপরাধবোধ তৈরি করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইমশোনালি ব্ল্যাকমেইল করা। আপনার কোনো দোষ থাকুক বা না থাকুক, এই ভয় দেখানো আপনাকে প্রথমেই পিছনের দিকে ঠেলে দেবে। প্রতিটা মানুষ চায় সমস্যা সমাধান করতে। আর সেই সমস্যা তৈরি করার পেছনে যদি তার নিজের কোনো দোষ থাকে, তাহলে তো ঝাঁপিয়ে পড়ে বেশিরভাগ মানুষ। যে মানুষগুলো অপরাধবোধ তৈরি করে আরেকজন মানুষের মধ্যে, তারা কিন্তু তাদের নিজস্ব চাহিদা বা নিজস্ব সমস্যার কথা বলে না। বরং আপনি কোন কাজটা করেননি যেটা করার কথা বা করেছেন, যেটা করার কথা না, সেটা দিয়েই আপনাকে ঘায়েল করে মজা পায় তারা। আপনার দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলে তারা আপনাকে ব্যস্ত রাখতে চায়।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করা উচিত, কীভাবে কথা বলা উচিত? তাদের অনুভূতি - সেটা দুঃখ হোক, রাগ হোক বা ক্ষোভ - সেটার সাথে আপনার দায়িত্ব গুলিয়ে ফেলবেন না। আপনার দায়িত্ব নয় সব সময় তার মন ভালো রাখা। বিশেষ করে আপনার যখন চরম ব্যস্ততা যাচ্ছে, সেসময় এই বাড়তি দায়িত্বটা একবারেই অপ্রাসঙ্গিক ও অগ্রহণযোগ্য। যেহেতু কাছের মানুষ, তাই শুরু করতে পারেন সহানুভূতি দিয়ে - যে, তার মন খারাপ বা তার পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না, এজন্য আপনি দুঃখিত। আপনার দায়িত্ব এবং অন্যদের অনুভূতিকে আলাদা করতে শিখুন। অপরাধবোধে ভোগার আগে এই প্রশ্নটা করুন যে, আপনি আপনার অবস্থান থেকে যেটা করার কথা, সেটা করেছেন কিনা। আর তার কারণে অন্যদের মানসিক অনুভূতির রেসপনসিবিলিটি সব সময় আপনাকে দেওয়া হয়নি। আপনি প্রথমেই যদি স্বীকার করে নেন যে দোষটা আপনার, তাহলে আপনার মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হবে খুব সহজেই। তাই প্রথমেই ভালো করে খেয়াল করুন, অপরাধবোধটা যুক্তিযুক্ত কিনা। প্রিয়জনের মন খারাপ, এই জন্য আপনিও তার প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করতে পারেন। একটি সুস্থ সম্পর্কে মানুষ অনুভূতি নিয়ে কথা বলে, দোষ দিয়ে নয়।
২। নীরব অবহেলা (Silent Treatment)
জানিনা বাংলাটা সঠিক হলো কিনা, আমি বোঝাতে চেয়েছি সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট (নীরব ব্যবহার/নীরবতার মাধ্যমে শাস্তি)। আপনি একজন মানুষকে একটা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু বিষয়টা তার পছন্দ হয়নি বা আপনার প্রশ্নের ধরনটা তার ভালো লাগেনি। এমন হতে পারে স্বাভাবিক একটি কথোপকথনে তেমন কোনো কথার লড়াই (বাকযুদ্ধ/বাদানুবাদ) হয়নি, কিন্তু হঠাৎ করে অপরপক্ষ চুপ করে গেল। হয়তোবা শব্দচয়নে একটা দু'টা শব্দ তাকে আঘাত দিয়েছে। সে প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে পুরোপুরি চুপ করে গেল। শুধু চুপ করে গেলেই হয়তো বা ভালো হত। সে একবারে কথাবার্তা বন্ধ করে দিল এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দিল আপনার সাথে। ডাক দিলে সাড়া দেয় না, কথা বললে উত্তর দেয় না, ফোন করলে ধরে না, মেসেজ (বার্তা) দিলে সেটারও কোনো রিপ্লাই নেই। এটাই হচ্ছে নীরব ব্যবহার। অর্থাৎ মৌনতাকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা। এক সময় আপনার মনে হতে থাকবে, আপনি মনে হয় আসলেই ভুল করে ফেলেছেন। আবারও সেই অপরাধবোধ। এই অস্ত্রটা কেন কাজ করে? কারণ মানুষের চরিত্রটা তৈরি হয়েছে অপরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য, কথা বলার জন্য। সেটা হঠাৎ করে ভেঙে গেলে মানুষের মস্তিষ্কে একটা চাপ তৈরি হয়। এক সময় আমরা হার মেনে নিই এবং ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে থাকি।
কীভাবে এই পরিস্থিতিতে সঠিক আচরণ করতে হয়? মূল কারসাজিটা হচ্ছে, মৌনতাকে পুরোপুরি শক্তি অর্পণ না করা। তাদের পেছনে সমস্ত শক্তি এবং সময় ব্যয় না করে বরং তাদেরকে এই বার্তা দিন যে, তারা যখন কথা বলতে চাইবে, তখন আপনি কথা বলার জন্য তৈরি। তারা কথা বলতে না চাইলে, জোর করে কথা বলানোর মতো ভুল করতে যাবেন না। স্পষ্টভাবে বলুন যে আপনি কথা বলতে চান, যখন সে তৈরি কথা বলার জন্য। কিন্তু আপনাকে উপেক্ষা করাটা তার উচিত হচ্ছে না। এই আচরণটা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে আবার নিয়ে আসবে।
৩। বাস্তবতা বিকৃত করা (Gaslighting)
আমি জানি, এটার বাংলা ভালো কোনো প্রতিশব্দ নেই। ইংরেজি শব্দ হচ্ছে গ্যাসলাইটিং (মানসিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি)। এই নামে ১৯৩৮ সালে একটা নাটক বের হয়েছিল। তখন বাসাবাড়িতে গ্যাস দিয়ে আলো জ্বালানো হত। সেই সিনেমাতে একজন স্বামী ইচ্ছা করে এক একদিন বাসার আলো কম বা বেশি করে রাখতেন এবং স্ত্রী-কে বলতেন যে তিনি আলো ঠিক রকম দেখতে পাচ্ছেন। প্রতিদিন এরকম বাসার আলো কম বেশি হয় , কিন্তু স্বামী পুরোপুরি ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেওয়ার পর একসময় স্ত্রীর মনে হতে থাকে, তার নিজেরই সমস্যা আছে। সে আশপাশের জগত সম্পর্কে আসলে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। এক সময় তার আত্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরে এবং সে ধীরে ধীরে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। এই জন্য এই ধরনের আচরণকে বলা হয় Gaslighting (মানসিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি)। প্রাত্যহিক জীবনে মানসিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি অনেক রকম ভাবে হতে পারে। এবং এটা কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। অফিসের বস (কর্তা) তার সহকর্মীদের (কলিগ) সাথে মানসিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেন। কখনো কখনো শিক্ষক ছাত্রদের সাথে করেন। কখনো বা বন্ধু-বান্ধব একজন আরেকজনের সাথে করে। মনে করেন আপনি আপনার কাছের মানুষের সাথে কোনো একটি বিষয়ে পরিকল্পনা (প্ল্যান) করেছেন। যখন সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার সময় এলো, তখন সে বলে বসল, এমন কোনো কথা তার সাথে আপনি কোনোদিন বলেননি। আপনার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, তখন সে বিভিন্নভাবে মনে করিয়ে দিল, আপনি কোন কোন বিষয়ে তাকে বলতে আগেও ভুলে গিয়েছিলেন। এক সময় আপনি নিজেই ভাবা শুরু করলেন, হয়তো আসলেই এই বিষয়ে কথা বলা হয়নি!
মূল কথা হচ্ছে, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা যখন মানুষ তার নিজস্ব বিচার বিবেচনাকে প্রশ্ন করা শুরু করবে। যিনি ম্যানিপুলেট করতে চাচ্ছেন, তিনি শিকারের চারপাশের বাস্তবতাকে বিকৃত করে তার কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করতে পারলে ভিকটিম একসময় ভেঙে পড়ে। ভিকটিম তখন তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণার চেয়ে ম্যানিপুলেটরের বর্ণনাকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করে।
এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? রেকর্ড (নথি/প্রমাণ) রাখার অভ্যাস করা শুরু করুন। যখনই সম্ভব হয়, আপনার গুরুত্বপূর্ণ কথা এবং কাজের প্রমাণ রাখা শুরু করুন। আপনার মনে হতে পারে আপনি কি তাদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছেন? ব্যাপারটা মোটেও তা নয়, বরং আপনি নিজের জন্যই এই প্রমাণগুলো, এই নথিগুলো সংরক্ষণ করবেন। যেন আপনি নিজেকে বোঝাতে পারেন যে আপনার চারপাশের জগত সম্পর্কে আপনার যেই ধ্যান ধারণা, সেটা সঠিক। অন্য কারো বর্ণনাকে নিজের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করার প্রয়োজন নেই। কারণ আপনার কাছে প্রমাণ আছে! আত্মবিশ্বাস হারানোর কোনো কারণ নেই।
লেখক: মার্কিন প্রবাসী প্রকৌশলী
Comments