নারী অধিকার ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের দাবি

২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ অগ্রযাত্রায় নানা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। সমতার দাবিকে অবমূল্যায়ন করে মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে নিয়মিতই অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে সমাজে নারীর প্রতি কাঠামোগত বৈষম্য সবসময় বিদ্যমান থেকে যায়। এ অবস্থার উত্তরণে নারীর অধিকার ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের দাবি জানিয়েছেন নারীরা।
রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে গতকাল 'নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা' কর্মসূচিতে পাঠ করা ঘোষণাপত্র থেকে এ দাবি জানানো হয়। ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন জুলাই শহীদ পরিবারের তিন নারী সদস্য। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে বেলা সাড়ে ৩টায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ কর্মসূচি শুরু হয়।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম কোনোটাই সরস নয়, সমরূপী নয়। জাতীয় ঐক্যের দোহাই দিয়ে নারী বা অন্য কোনো প্রান্তিক গোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা ও সমাজে ন্যায্য অবস্থানের দাবিকে অস্বীকার করা যাবে না। নারীর অধিকার একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের নির্ণায়ক। সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত না করে সবার জন্য মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের দাবি জানিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে সব মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বৈষম্যবিরোধিতা ও সাম্যের যৌথ মূল্যবোধের ওপর। নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত সংখ্যালঘু, হিজড়া ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিচয়ের নাগরিকের রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো শর্তাধীন হতে পারে না। এ মৌলিক বিষয়গুলোকে হুমকির মুখে রাখলে তা হবে অর্ধশতকের নারী আন্দোলন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও ইনসাফের ধারণার পরিপন্থী।
ব্যক্তিগত আক্রমণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা এবং অনলাইনে হয়রানি করে রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে দাবি করে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রতিবেদন প্রকাশের পর অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত সুপারিশগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়ে এবং গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ না রেখে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এর পরও জুলাইয়ে অসংখ্য নারীর আত্মত্যাগ ও শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নারীর ওপর অব্যাহত নিপীড়ন, অবমাননা ও অপমানের বিরুদ্ধে আশ্চর্য রকম নিশ্চুপ। সরকারের নিজের তৈরি করা নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যদের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণের পরও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। নারী ও প্রান্তিক জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, যারা আমাদের সমর্থন চায়, নির্বাচনী অঙ্গীকার অথবা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও এসব জনগোষ্ঠীর পূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত মুক্তির বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। আসন্ন নির্বাচন থেকেই তাদের প্রার্থীদের অন্তত ৩৩ শতাংশ (ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে) নারী হতে হবে।
ঘোষণাপত্র পাঠ করা শেষে 'নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা'র একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে ইন্দিরা রোড ঘুরে পুনরায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে এসে শেষ হয়। এ সময় মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা নারী অধিকারসংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন।
এর আগে 'সমতার দাবিতে আমরা' স্লোগানে একত্র হয়ে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, নারী মুক্তি কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিল উইমেনস ফেডারেশন, আদিবাসী ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ নারী জোট, নারী সংহতি, ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), তীরন্দাজ, শ্রমিক অধিকার আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।
Comments