ভুল

সীমান্ত চৌধুরী। ডাক নাম অনুকাব্য। কাঞ্চননগর কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। তার আগে ব্র্যাকের মাইক্রো ফাইন্যান্স বিভাগে কাজ করতেন।
এখন বাজে রাত তিনটে। ব্যক্তিজীবনে মিঃ অনুকাব্য দেশ পরিবার সমাজের তেমন কিছু হতে না পেরে, রাতের পর রাত জেগে মানুষের অস্তিত্বে — 'লেগে থাকে দুর্দশা' গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখে চলেছেন। ঘরের কয়েক জোড়া টিকটিকি পরিবার হঠাৎ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিদারাবাদ ট্র্যাজেডি হয়ে রাতারাতি নাই হয়ে গেল দেখে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। টিকটিকি সমাজের এমন হঠাৎ অন্তর্ধান রহস্য ভাবিয়ে তুলল মিঃ অনুকাব্যকে। কিছু কুল কিনারা করতে না পেরে শেষমেশ দেখা গেল,— রান্না ঘরের লাগোয়া ওয়াশ রুমের সামনে এক মরা টিকটিকি পড়ে আছে। ভালো করে পরখ করে পোস্টমর্টেম আতশ চোখে দেখা যায়, টিকটিকির দু'চোখ নাই জিহ্বা রক্তমাখা। টিকটিটির সামনের দুই হাত ধনুকের মতন বাঁকানো। মানুষের মতো সেও তার চোখ দুটো উঠিয়ে নেবার আগে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিয়েছিল মর্মে দৃশ্যত বিবরণে প্রকাশিত। মানুষের লাশের মতন তারও মৃত্যুর আগে গুহ্যদ্বারে আঠালো দুর্গন্ধ মলের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত।
কবি অনুকাব্য লেখায় উঠে আসে —মানুষের অস্তিত্বের সাথে দুর্দশা নিবিড়ভাবে জড়িত, যা শারীরিক কষ্ট, মানসিক যাতনা, সামাজিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ এবং দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো অপমানের মতো বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। কিছু ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যায় যদিওবা মানব জীবনের চরম হাহাকার বঞ্চনা নৈরাশ্যের দেখা আয়নাতে —একে ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ, কর্মফল বা মানুষের নিজস্ব ভুল সিদ্ধান্তের ফল হিসেবে দেখা হয়। আবার —
অস্তিত্ববাদীরা এটিকে মানব অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অস্তিত্ববাদীরা মনে করেন, মানুষের সত্তা শুধুমাত্র একটি মন বা চেতনা নয়। মানুষের এই চলমান পরিস্থিতি এবং অস্তিত্বের যৌথ উপলব্ধির পটভূমিতে দুর্গতি একটি স্বাভাবিক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র ও ভয় পেতেন। অপ্সরা মেনকাকে মর্ত্যে পাঠিয়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনির সাধন ভজন ঘায়েল করে সংসার করিয়ে প্রখর আধ্যাত্মিক শক্তি কেড়ে নেন। মুনিবর যখন টের পান; তাঁকে আসলে সুখের এক মোহ মায়া দিয়ে ভয়ঙ্কর দুর্গতি কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। টের পেয়ে স্বর্গের অপ্সরা মেনেকাকে ছেড়ে যান। পরে গায়ত্রী মন্ত্র রচনা করেন।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রের দীর্ঘ ত্যাগের পর এবং কঠোর সাধনার মাধ্যমে প্রাপ্ত 'গায়ত্রী মন্ত্র' তাঁর ঋষিত্বের চূড়ান্ত পরিণতি এবং ঋগ্বেদের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এক একটি ভুল মানে —গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসি, ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং মেসোপটেমীয় গিলগামেশের মহাকাব্য। ভুল একটি যাপিত জীবনের মহাকাব্য। যাকে মানুষের পড়তে হয়, জানতে হয়। ভুল শাস্ত্রে ভুলই সঠিক। মোহ ভুলো মনে হয় ভুলের জন্ম। এক একটি গত বর্তমান মহাকাব্যিক ভুলে জন্ম নেয় — মোহাম্মদ ঘুরি, চেঙিস, বর্গী, ইংরেজ মীর জাফর, মোহাম্মদী বেগ, চে গুয়েভারা চিহ্নিত রাখাল বালক।
টিকটিকি সমাজ মনে করেছিল,— সামান্যইত ঘাস ফড়িং। ঘরে এসেছে সুস্বাদু আহার। চলে এসো। আমরা মানুষের মতো লুটপাট ধর্ষণে জাতপাত ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে মিলেমিশে সবাই খেয়ে নিই। যা হবার তা হয়েছে। আগামীতেও হবে। একাকি দুর্বল ভেবে পৃথিবী শিক্ষায় কাউকে আঘাত করতে নাই। মানুষের মতো টিকটিকি সমাজের মাথামোটা বলবান টিকটিকিটাও চিন্তা করেনি, প্রাণী হৃদয়ে চিত্তবল ধৈর্য্যবল বাদে — বাহুবল ধনবল জনবল চিরকাল কারোরই কখনো থাকে না।
ঘাসফড়িং মাথা গরম করেনি। সে ধৈর্য্য ধরে টিকটিটি সমাজের অবহেলা হাসি
খাব খাবো রসনা তৃপ্তির আগাম ঢেঁকুর
তোলা দেখে — কৌশল পাল্টে তার সামনে দু'পায়ে থাকা কাঁটা দিয়ে
দু'চোখ তুলে নেয়। টিকটিকি নীচে পড়ে যায়। ঘাসফড়িং টিকটিকি চোখ খেতে দেখে — মানব সমাজের মতো টিকটিকি সমাজেরও কোনো টিকটিকি বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। কোন টিকটিকি তাদের গোপনে থাকা সরীসৃপ হাসপাতালে নিয়ে যায় নি।
অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া দাঁত চোখ উঠানো যে কত কষ্টকর মৃত্যুসম যন্ত্রণা! তা সাপুড়ে কিংবা উৎসাহী মানুষদের বোঝানো যায়নি।
সরীসৃপ সমাজে মানব সমাজের মতো
পুলিশ মব সেনাবাহিনী উপদেষ্টা কিংবা সাংবাদিক নেই। ফরেনসিক ডাঃ বিশেষজ্ঞ ও নাই দেখে কবি অনুকাব্য — মানুষের মতো সাদা কাফনে একটি সাদা টিসু কাফনের কাপড় বানিয়ে অজ্ঞাতনামা লোভী মূর্খ টিকটিকির লাশ চালান লিখে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দেন। ঘরে মরা টিকটিকি ফেলে দিলে নাকি শ্মশান কবর দাফন সৎকারের মতো করে গোসল সেরে নিতে হয়। কবি অনুকাব্য তা ই সেরে নেন। ঘাস ফড়িংটা বলে চলেছে —আমার বুকটা জ্বলছে। ওর চোখগুলো ছিল ঠিক মানুষের মতো। মহাভারত চরিত্রে শকুনির হাতে বানানো গরল চরিত্র চরম বিষাক্ত।
আমি ছিলাম তোমাদের কবি জীবনানন্দ। সময়ের চরম গরল বিষাক্ত টিকটিকি অদ্ভুত আঁধার চোখগুলো এখন তোমাদের আশে পাশে। আমি অপবিত্র অস্পৃশ্য নই। প্রজাপতি হরিণ ব্যাঘ্র চামড়া শিং পুরাকীর্তি সংরক্ষণ মনে তোমার পাশে রেখে দিও।
ভুলের পরিণাম হয় — এক একটি জাতির মহাভুল। হয়, ইতিহাস কিংবা অপ ইতিহাস পুরাকীর্তি নালন্দা ট্রয় নগরী।
মানুষের ভু্লের পরিণামে হয়েছিল —
মোহ গন্ধম আহার।
এই জগৎ সংসার সমৃদ্ধি উচ্চাভিলাষ দেবতা ঋষি মুণি সৌর্য বীর্য কবিতা ভূগোল ইতিহাস।
ভুলে ভুলে হয় ভুলে ভরা ইতিহাস
ভুলে ভুলে বিস্তৃত হয় —
ভুলে ভরা চিন্তা কাম প্রেম পরিবার সমাজ ভুল সংসার
ভুলে ভরা এক একটি রাষ্ট্র সমাজ
জাতি
জাতীয়তা সংবিধান চিন্তা চেতনা
ভুল জীবনের গল্প
ভুল জীবনের পরতে পরতে দেশমাতা
সংসার ছেড়ে মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
'মানুষের কাজকাম নাই
এমন নাদুস নুদুস টিকটিকি জীবনে যত যত
পাই তত তত ঘাসফড়িং ধরে খাই
ভুলে ভরা পৃথিবীতে ভুল মানুষেরা ভোলা মনে বলে চলেছে'।
Comments