নীরব নায়কের গল্প — ৭

বিকেলের নরম রোদে হাঁটছিল রায়হান। হঠাৎ পকেটের ফোনটা কেঁপে উঠল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো দুঃসংবাদ—মিনু আপা আর নেই। বহুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। আজ বিকেলেই হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে—সব শেষ।
চুপচাপ ঘরে ফিরে অর্নাকে বলল রায়হান, 'চল, গ্রামের বাড়ি যাই। শেষবার দেখা করে আসি'।
অর্না কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তৈরি হতে গিয়ে মনে পড়ে গেল পুরোনো দিনের গল্প—বিশেষ করে মিনু আপার মেয়ে তান্নীর সঙ্গে কাটানো সেই সোনালি শৈশব।
মধ্যবিত্ত জীবনের মতোই সম্পর্কগুলোও জড়িয়ে থাকে এক জটিল গোলকধাঁধায়। নিঃশব্দে গড়ে ওঠে, আবার নিঃশব্দেই হারিয়ে যায়।
তান্নীর সঙ্গে প্রথম দেখা—এক ঈদের দুপুরে। মিনু আপার উঠোনে মাটির গন্ধ মাখা বাতাস, আর ভাগ করে খাওয়া কুড়ানো আমড়া। সেই দিনই তান্নী বলেছিল এক আজব গল্প—এক পুতুল, এক রাজা আর হারিয়ে যাওয়া এক নদীর কাহিনি।
তখনই অর্না বুঝেছিল, তান্নীর কল্পনার জগৎ অনেকটা তার নিজের মতোই—রঙিন, বুনো, স্বপ্নে মোড়া।
'তোমার মনটা খারাপ লাগছে, তাই না?' রায়হানের প্রশ্নে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে অর্না। ধীরে বলল, "আমাদের জীবনের গল্প কেউ লেখে না, রায়হান। আমরা নিজেরাই নিজেদের গল্পের নীরব নায়ক।" চোখে ভেসে ওঠে সেই পুরোনো দুপুরগুলো—স্কুল ছুটির পর তান্নী বারান্দায় বসে অঙ্ক কষছে, পাশে বসে আছে অর্না।
তান্নী ছিল জ্ঞানপিপাসু, কিন্তু অসম্ভব কোমল।
মিনু আপার রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত ডাক, "তান্নী, বাড়ীর কাজ শেষে হারিকেনের চিমনি মোছার কথা মনে আছে তো?" কাল থেকে শাওনের পরীক্ষা শুরু। তান্নী বই বন্ধ করে উঠে যেত। শাওন, ওর ছোট ভাই।
একবার ক্লাস এইটে স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা লিখেছিল অর্না। তান্নী পড়ে বলেছিল, "তুই লিখে যা, মানুষ তোকে মনে রাখবে।" সেই কথাগুলো এখনো প্রতিধ্বনিত হয় অর্নার মনে।
মিনু আপা ছিলেন সহজ-সরল মাটির মানুষ। কথা বলতেন নরম গলায়, কিন্তু মন ছিল দৃঢ়তায় ভরা। বলতেন, "তান্নী অনেক দূর যাবে, আমি ওর জন্য যা পারি করব।" অর্না ভাবে, মিনু আপা হয়তো নিজে অনেক দূর যেতে পারেননি, কিন্তু তান্নীর জন্য পথ তৈরি করে গেছেন। সেটাই তো দূরদর্শী অবিভাবকের প্রকৃত সার্থকতা।
গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে রায়হান বলল, "মানুষ হয়তো চলে যায়, কিন্তু তাদের ছায়া থেকে যায়।"
চোখে পড়ে সেই চেনা গেট, ধুলোমাখা সাইনবোর্ড—"জামতলা পাড়া।" অর্নার গলা ভার হয়ে আসে। সে জানে, মিনু আপার উঠোনে আর বসবে না কোনো চায়ের আড্ডা। তান্নী হয়তো এখনো চোখের পানিতে অপেক্ষা করছে।
এই মাটিই তো তাদের শিকড়—ভালোবাসার গন্ধমাখা মাটি। রাস্তার দু'পাশে ছায়া ফেলছে সবুজ গাছ। এই পথেই তো একদিন তান্নী শাওনের হাত ধরে স্কুলে যেত।
মিনু আপা বলতেন, "তান্নী খুব দায়িত্বশীল।"
আজ সেই তান্নী ঢাকায় চাকরি করে। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে ছবি দেয়—মায়ের সঙ্গে নয়, নিজের বইয়ের পাশে। জীবন ধীরে ধীরে পাল্টে দেয় মানুষকে।
দাফনের পর বিকেলের আলো ধূসর হয়ে আসে। আত্মীয়স্বজন উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে, কেউ গল্প করছে, কেউ স্মৃতিতে ডুবে।
অর্না দরজার কাছে দাঁড়িয়ে খুঁজছিল তান্নীকে। পায়নি। শেষে দেখে, সে পিছনের বাগানে, একা বসে আছে। অর্না কাছে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
হঠাৎ তান্নী বলে, "মা চলে গেল। তবু এখনো মনে হয় রান্নাঘর থেকে ডাকবে—'তান্নী, কই রে তুই?'"
অর্না বলল, "আমি জানি।"
চোখের কোণে স্মৃতির জল জমে।
"তোর মনে আছে?" তান্নী জিজ্ঞেস করল, "একবার আমরা মাটির পুতুল বানিয়ে খেলেছিলাম? মা তখন বলেছিল—'তোমাদের মধ্যে আগুন আছে, শুধু জ্বালাতে শিখো।' এখন বুঝি, মা ঠিকই বলেছিল।" অর্না মৃদু হাসে, "তোর কথাগুলো আগের মতোই রয়ে গেছে... গভীর।"
"আজকাল খুব একা লাগে," বলল তান্নী। "এই উঠোন, এই গন্ধ... একটা নির্ভরতার মতো।"
অর্না ধীরে বলল, "এই বাড়িটাই তো আমাদের গল্পের শুরু, তাই না?" তান্নী তাকিয়ে বলে, "তুই কি আবার লেখালেখি শুরু করিসনি?"
অর্না মাথা নাড়ে, "তোর বলা সেই কথাটাই তো... 'তুই লিখে যা'। আমি লিখছি। তোর আর মিনু আপার গল্প থাকবে তাতে।"
তান্নী উঠে দাঁড়ায়। বাতাসে ভেসে আসে মিনু আপার কণ্ঠস্বর—মৃদু, শান্ত, কাঁসার থালার মতো।
"চল, তোকে উঠোনটা দেখাই। মা বলত, 'যে বাড়ির উঠোন বেঁচে থাকে, সে বাড়ি কোনোদিন পুরনো হয় না।'"
অর্না হালকা হাসিতে পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।
পেছন থেকে ভেসে আসে রায়হানের ডাক, "চলো অর্না, এখনই ফিরতে হবে। সন্ধ্যার পথে ঝুঁকি থাকে।"
অর্না বিদায় নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে।
Comments