নীরব নায়কের গল্প — ৬

সকালের নরম রোদ জানালার কাচ ছুঁয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। রায়হান আজ অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই জেগে উঠেছে। ঘুমভাঙা চোখে সে জানালার বাইরে তাকায়নি, শহরের ছাদবিহীন কোলাহল নয় — তার মন ছিল অন্য কোথাও। মায়ের প্রতি এক নীরব দায়িত্ববোধ আজও তাকে নীরবে জাগিয়ে তুলেছে। বহুদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভোগা মায়ের খাবার নিয়ে সে ছোটখাটো যত্নের একটা নিজস্ব তালিকা গড়ে তুলেছে। তার প্রতিটি প্লেট যেন শুধু পুষ্টি নয়, ভালোবাসার কোমল ছোঁয়া বয়ে আনে।
বাজারের ব্যাগে আজও প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে ছিল কিছু বিশেষ যত্নের ছায়া। সবজির ঝুড়িতে কচি পুঁইশাক, নরম ধুন্দল, টাটকা বেগুন আর দু'রকমের ছোট মাছ। নিজের জন্য নিয়েছে মিষ্টি ঘ্রাণে ভরা মৌসুমি আম — তিন কেজি। আর মায়ের জন্য জাম, বেদানা আর সেই পরিচিত নরম স্বাদের নেক্সাস বিস্কুট। খাবারের আড়ালে যেন আগেভাগেই দেখে নিয়েছে মায়ের মুখের প্রশান্ত হাসিটা।
দিনের আলো ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ল বিকেলের দীর্ঘ ছায়ায়। বাজার, অর্নার হাতের রান্না, ছোটখাটো কাজ সামলে ক্লান্ত শরীরেও জমে রইল একরাশ প্রশান্তি — দায়িত্ব পালনের নিঃশব্দ তৃপ্তি। ঠিক এমন সময় পুরনো বন্ধু মাসুদের ফোন। জরুরি কিছু কথা, তাই সন্ধ্যার আড্ডায় ডাক।
সন্ধ্যার সেই ছোট্ট আড্ডায় মাসুদের সঙ্গে হাজির ছিল আরেকজন বন্ধু — আরিফ।
আরিফ, এই শহরের আরেক নীরব নায়ক। সাধারণ এক ব্যাংক কর্মকর্তা। দিনভর ফাইলের নিচে চাপা পড়া হিসেব-নিকেশ, মুখে কৃত্রিম সার্ভিস-হাসি, আর রাত বাড়লেই সেই হিসেবের ভারে ক্লান্ত মন।
মাসুদ কথা বলছিল — তার ছেলে প্রবাল অস্ট্রেলিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাচ্ছে। ভিসার শর্ত, ৫০ লাখ টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স। সংকোচে রায়হানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল — কিছু সাহায্য করা সম্ভব কি না। কথার ফাঁকে উঠল মলয় দাদার ছেলের গল্প — তার গন্তব্য জার্মানি। একই স্বপ্ন, একই অর্থের বাধা।
আরিফ তখন ধীরে বলল,
'বুঝলে রায়হান, এখনকার দিনে টাকা চাইতে কেউ আর লজ্জা পায় না। বরং এটাকেই বুদ্ধিমত্তা বলে — এই বাজারে টিকে থাকার কৌশল। অথচ, এই শহরের কত মানুষ প্রতিদিন ঋণের নিচে ডুবে যাচ্ছে, কেউ টের পায় না। রাতের পর রাত হিসেব মিলাতে পারছে না, কিন্তু অফিসে গেলে মুখে থাকে সেই চেনা হাসির মুখোশ'।
একটু থেমে যোগ করল সে,
'খবর দেখেছো তো? প্রবাসী ভাইয়েরা একের পর এক দেশে ফেরত আসছে। ওদের ফেরা মানে শুধু প্লেনের টিকিট না — ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের বোঝা, পরিবারের হতাশ মুখ, আর একরাশ অনিশ্চয়তা। দেশের অবস্থা তো তুমি জানো — গার্মেন্টস বন্ধ হচ্ছে, কারখানায় তালা পড়ছে। হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। চারপাশে যেন তালাবদ্ধ কাচঘর। বাতাস ঢুকছে না, আলোও নয়।"
রায়হান চুপ করে শুনছিল। বাস্তবতার এই কথাগুলো তার ভেতর এক অদৃশ্য ভার ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
রাত পেরিয়ে গেছে দশটা। শহরের বাতাসে নেমেছে নিঃশব্দতার ঘন চাদর। ঘরে ফিরে রায়হান ফ্রেশ হয়ে নিঃশব্দে ডিনারের টেবিলে বসল। খাবারের মাঝে ভাঙা কণ্ঠে অর্নাকে বলল,
'আজ মাসুদ আর আরিফের সঙ্গে দেখা হলো। মাসুদের ছেলের ভিসার জন্য টাকার দরকার। আরিফ বলছিল — হিসেবের মধ্যে আটকে গেছে জীবন। এখন বাঁচার বদলে শুধু সারভাইভ করছি।"
অর্না শান্ত গলায় বলল,
'জানি না তুমি কী উত্তর দিয়েছো। তবে একটা কথা মনে রেখো রায়হান —
'যে জন দিবসে মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি,
অন্ধকারে সে জ্বালিবে কেমনে
প্রেমের প্রদীপ শিখা?'
সময়ের অভিঘাত এত কঠিন হয়ে গেছে, মানুষ স্বপ্নের বদলে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজছে।
বিশ্বের অর্থনীতি থমকে গেছে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম ছিঁড়ে দিগন্ত পেরিয়েছে। চাকরি নেই, বিনিয়োগ নেই, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নেই। শহরের অলিগলি থেকে আন্তর্জাতিক অর্থবাজার — সবখানে কুয়াশার মতো অনিশ্চয়তা। এই শহরের নীরব নায়কেরা প্রতিদিন নেমে যায় এক অদৃশ্য যুদ্ধের ময়দানে। কিন্তু কেউ তাদের গল্প লেখে না। কেউ তাদের খোঁজও রাখে না'।
রায়হান জানে, অর্নার প্রতিটি কথা যেন তার নিজের মনেরই প্রতিধ্বনি।
সে ধীরে মাথা নাড়ল। নিঃশব্দ সম্মতি।
জীবন — এখন কেবল টিকে থাকার আরেক নাম।
Comments