নীরব নায়কের গল্প — ৫

গ্রামের আকাশ ছিল শান্ত, প্রশান্ত নীল। ঠিক মায়ের আঁচলের মতো — কোমল, আরামদায়ক। সেই নীলের ভাঁজে ভেসে থাকত শালিক-পাখির ডানায় বোনা গান, কাঁঠালের পাকা গন্ধে ভেজা বাতাস, আর সোনালি ধানের ক্ষেতে হারিয়ে যাওয়া অলস বিকেল।
পুকুরঘাটে তাল-গাছের ছায়ায় বসে থাকা বৃদ্ধেরা বিকেলের আলোয় গল্প করত। কেউ বলত চাচাতো ভাইয়ের নতুন চাকরির খবর, কেউ বা স্মৃতিচারণ করত কোন আত্মীয়ের বিয়ে বা জমির ঝামেলার গল্প। উঠোন পেরিয়ে পাশের বাড়ির খালা এসে বলতেন — 'বউমা, আজ আমাদের বাড়ির শাক পাতা বেশি হয়েছে, একটু পাঠিয়ে দিলাম'। সেই শাকের সঙ্গে যেন গ্রাম্য ভালোবাসার স্বাদ মিশে থাকত।
কিন্তু সময় তো কখনও কারও জন্য থামে না। মানুষ বড় হয়, স্বপ্ন বদলায়, জীবন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। রায়হানের জীবনও বদলে গিয়েছিল। গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের ইট-পাথরের গল্পে ঢুকে পড়েছিল সে। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন উপন্যাসের পৃষ্ঠা, শেষ হয় ঠিকই, কিন্তু অনুভূতির গল্প থেকে যায় অপূর্ণ, বুকে জমা হয় নীরব স্মৃতির মতো।
এক বিকেল, শহরের এক ক্যাফেতে বসে কফির কাপে গরম ধোঁয়ায় পাক খাচ্ছিল স্মৃতির সুগন্ধ। তার ঠিক সামনে বসে ছিলেন মকবুল চৌধুরী। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর, কিন্তু চোখে তখনও শান্ত দীপ্তি।
কৌতূহলী গলায় রায়হান জানতে চেয়েছিল, — আপনার জীবনের শুরুর গল্প কেমন ছিল, চৌধুরী ভাই?"
চৌধুরী সাহেব ধোঁয়ার পাকের ভেতর কিছুক্ষণ হারিয়ে থেকে, নরম কণ্ঠে বললেন — "খুবই সাদামাটা। আমার পৃথিবী ছিল শুধু মা। তাঁর আঁচলের গন্ধেই শিখেছিলাম নিঃশব্দ ভালোবাসার অর্থ। তখন বুঝিনি, সেই আঁচলই একদিন হয়ে উঠবে দূরত্বের প্রতীক।"
একটুখানি থেমে স্মৃতির ভারে কণ্ঠ নরম হয়ে এলো। — "আমার মায়ের নাম ছিল নীলা। উনুনে জ্বলা আগুন, ডালের ঘ্রাণে গড়া ছিল আমাদের সংসার। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে মা হাতে ছুঁয়ে দোয়া দিতেন। দুপুরে কড়াইতে ভাজা বেগুন ভর্তা আর গরম ভাতের সঙ্গে গাঁয়ের ঘ্রাণ মিশে থাকত। সময় গড়াতে গড়াতে বড় হয়েছি, আর মাকে রেখে এগিয়ে গেছি।
একদিন নিজেই বলেছিলাম — 'মা, বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাও। ওখানে অনেকের সঙ্গে থাকবে, যত্ন পাবে।' মা মাথা নেড়েছিলেন নীরবে। মুখে কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু চোখে ছিল সমুদ্রসম অপ্রকাশিত ভালোবাসা। বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে মা খুঁজে পেয়েছিলেন আরেক সন্তান — রুবি আর তার ছোট্ট মেয়ে পাখি।
একদিন পাখি আঁচলের নিচে মুখ লুকিয়ে বলেছিল — 'দাদু , সব মা কি ভালো হয়?' নীলা হেসে বলেছিলেন — 'সব মা একরকম নয়, পাখি। কেউ জন্ম দেয়, কেউ গড়ে তোলে। কেউ নিঃস্বার্থ ভালোবাসে, আবার কেউ ভালোবাসার বদলে চায় কিছু।' আমি বুঝলাম অনেক দেরিতে, রায়হান — ভালোবাসা শব্দ দিয়ে মাপা যায় না। মা তো সবসময় নিঃশব্দেই ভালোবাসে।"
রায়হানের গলা কেঁপে উঠেছিল। — আপনার মা ছিলেন সত্যিকারের মা।
চৌধুরী সাহেবের ঠোঁটে ধরা পড়েছিল এক শান্ত হাসি। — "মায়ের ভালোবাসার গন্ধ কোনোদিন পুরনো হয় না, রায়হান। একদিন সেই আঁচলের গন্ধ তোমার জীবনেও ফিরে আসবে। শুধু মনে রাখতে হবে, ডাক দিলেই সাড়া দেবে।"
সেদিনের এই গল্প রায়হান শোনাল অর্ণাকে। গল্পের শেষে, অর্ণার চোখের কোণে জমে ছিল একফোঁটা নীরব জল। কয়েকদিন পর, অর্ণা আর রায়হান একসঙ্গে গিয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমে। বাগানের ধারে, পাখির হাত আঁচলে জড়িয়ে বসে ছিলেন নীলা। নিঃশব্দ, অথচ পরিপূর্ণ এক দৃশ্য।
ফেরার পথে রায়হানের মনে প্রশ্ন জেগেছিল — আজ অর্ণা এই অচেনা বৃদ্ধার জন্য যে মমতা দেখালো, সেই ভালোবাসার অর্ধেকও কি কখনো তার শাশুড়ির জন্য দেখিয়েছে?
ভালোবাসা কি শুধু রক্তের সম্পর্কে জন্মায়, নাকি সময় আর প্রত্যাশার ভারে তার শিকড় পাল্টে যায়?
হয়তো একসময় নীলাও খুঁজেছিলেন তাঁর শাশুড়ির আঁচলের সেই আশ্রয়, যেটা কোনোদিন পাননি। তাই নিঃস্বার্থভাবে দিয়ে গেছেন অন্য কারও সন্তানকে। অর্ণার চোখে তখনো সেই প্রশ্নের উত্তর লেখা হয়নি।
কিছুদিন পর, রায়হান অর্ণাকে নিয়ে ফিরে গেল তার শৈশবের গ্রামে। সেই একই নীল আকাশ, কাঁঠালের গন্ধে মোড়া বাতাস, সোনালি ধানের মাঠ — যেন সময় থেমে থাকা এক পুরনো ছবির মতো চারদিকে ছড়িয়ে। কাঠের বারান্দায় দাদার রেখে যাওয়া চেয়ার এখনো পড়ে আছে, তার ওপরে ধুলো জমে থাকলেও স্মৃতির গন্ধ আজও তাজা। উঠোনের কোণে নারকেল গাছের নিচে রায়হানদের পুরনো মাটির ঘরটা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। বিকেলের দিকে ঝড়ের আগে বাতাসে যে গন্ধ ভাসে — সেটা যেন ছেলেবেলার ঈদের আগের দিনের মতোই চেনা।
অর্ণা চুপচাপ চারপাশ দেখছিল। তার চোখে ধরা পড়ছিল, এই জীবনের সরল সৌন্দর্য। পুরুষেরা পুকুরঘাটে বসে গল্প করে — রাজনীতি, পুরনো সিনেমার গান, আত্মীয়ের চিকিৎসা, বাজারের নতুন খবর। নারীরা উঠোনে বসে আলাপ করে — কার মেয়ের বিয়ে কবে, কে নতুন শাড়ি কিনেছে, কার শাশুড়ি কেমন। জীবনের প্রাপ্তি এখানে যেন 'বিয়ে' নামের এক প্রাচীন প্রাপ্তির সারমর্ম। কিন্তু কেউ বিপদে পড়লে, এই গ্রামের মানুষেরা থেমে যায় না। শহরের মতো নয়, যেখানে পাশের ফ্ল্যাটে কেউ মারা গেলেও হয়তো জানালা খোলে না কেউ।
এখানে আত্মীয় মানে শুধু রক্তের সম্পর্ক নয় — পাশের বাড়ির চাচী, মামা, খালা, চাচা সবাই যেন এক অদৃশ্য আত্মার বন্ধনে বাঁধা।
অর্ণা ভাবছিল — এই গ্রাম, এই সরল জীবনের মানুষগুলো সময়ের দৌড়ে নেই। তাদের চোখে ক্লান্তি নেই, মুখে তাড়াহুড়ো নেই — কেবল শান্ত, স্থির ভালোবাসায় ভরা জীবন।
রায়হানও অনুভব করেছিল — হয়তো থেমে থাকাটাই কখনো কখনো জীবনের আসল সুখ। সময় আর স্বপ্নের মানে সবার জন্য এক নয়।
ঢাকায় ফেরার আগে, রায়হান মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলেছিল — — "মা, চল আমার ভাড়া ছোট্ট ঘরে ফিরি। এবার তোমার জন্য নতুন করে আমাদের ঘর সাজাবো। তুমি আগের মতো আমাদের ছায়া হয়ে থেকো।"
রাজিয়া বেগমের চোখে জমে থাকা জল নিঃশব্দে মিশে গেল প্রশ্ন আর ভালোবাসার অপূর্ণতায়। আঁচল বাড়িয়ে বললেন — "চল, বাবা। মনে রাইখো, এই বাড়ির দরজা তো সবসময়ই তোমার জন্য খোলা ছিল, থাকবে।"
ট্রেনের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে রায়হান মনে মনে বললো — ভালোবাসা শব্দে মাপা যায় না। মায়ের আঁচলে লেগে থাকা সেই গন্ধই তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
কারও আঁচলে লেগে থাকে নিঃশর্ত ভালোবাসা, কারও আঁচলে থেকে যায় নীরব অভিমানের গন্ধ।
আর সেই আঁচলের গল্প... কোনোদিন শেষ হয় না।
Comments