নীরব নায়কের গল্প — ৪

শহরের কংক্রিটের দেয়াল আর যান্ত্রিক জীবনের চাপে প্রতিদিনই যেন একরকমভাবে কেটে যায় — নিরব, নিস্তরঙ্গ। কাজের তালিকার শেষে জমে থাকা ক্লান্তি কবে যে মনের ভেতর ভারী হয়ে বসে পড়ে, কেউ ঠিক বুঝে ওঠে না। তবুও, এই একঘেয়ে জীবনের মাঝেই কখনো কখনো উঁকি দেয় ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্ত — ঠিক সেই রকম এক দিনের অপেক্ষায় ছিল রায়হান আর অর্ণা।
সেই প্রতীক্ষিত দিনটিতে, ভোরের আলো ফুটতেই ব্যস্ততার মোড়কে বাঁধা জীবনের গতি থামিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ল মুন্সিগঞ্জের শীলবাড়ির পথে। গাড়ির চাকা ঘুরতে ঘুরতে শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দূরে। সামনে অপেক্ষা করছিল এক টুকরো শান্ত গ্রাম —সবুজের ছায়ায় ঢাকা খোলা আকাশ আর নির্মল বাতাসে ভরা।
গ্রামের সরু মেঠোপথ, পুকুরপাড়ের ছায়াঘেরা গাছ, আর বাঁশবনের ফিসফাস শব্দ মিলে যেন সুরের মতো নিঃশব্দে বয়ে চলছিল এক আলাদা জগতের আমন্ত্রণ। কাঠের বারান্দায় পা রাখতেই মনে হলো — শীলবাড়ি যেন আপন ভেবে বুকে টেনে নিয়েছে সবাইকে।
উঠোনে ঢোকার পরেই প্রথম যে জিনিস মন ছুঁয়ে গেল, সেটা আতিথেয়তার সরল সৌন্দর্য। নাস্তার টেবিলে সাজানো ছিল ছিট রুটি, ডিমভাজি, গরম ভর্তা — আর তার চেয়েও মধুর ছিল ভাই-ভাবীদের প্রাণখোলা হাসি। শহরের অভিজাত রেস্তোরাঁয় হয়তো দামি খাবার পাওয়া যায়, কিন্তু এমন আন্তরিকতার স্বাদ সেখানে কল্পনাও করা যায় না।
নাস্তার পর শুরু হলো ছবি তোলার উৎসব। কেউ পুকুরপাড়ে, কেউ গাছের ছায়ায় — সবাই মিলে হাসির মুহূর্তগুলো বন্দী করতে ব্যস্ত। রায়হানের চিরচেনা কৌতুক আর গল্পের জালে হাসির ঝড় উঠল, যদিও মাঝে মাঝে সে কারো কথা বলার আগেই নিজেই কথার স্রোত বইয়ে দিল — আড্ডায় বেশি কথা বলার সেই পুরনো স্বভাব ঠিক একইরকম রয়ে গেছে। অন্যকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে, এ কথা তাকে কে বোঝায়।
এই সফরের নীরব নায়ক ছিল শীলবাড়ির এক স্টাফের কিশোর ছেলে — লালন। বয়সে ছোট হলেও, তার আন্তরিকতা আর সহজ-সরল আতিথেয়তায় সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। লালনের চোখ দিয়ে গ্রামটাকে দেখা মানে, যেন নতুন করে আঁকা একটা ছবির ফ্রেম খুলে যাওয়া।
দুপুরের খাবারের আয়োজনে ছিল শুটকি ভর্তা, মুরগির ঝাল মাংস, রুই মাছ ভাজা, চিংড়ি সবজির ঝোল, টক ডাল আর ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। পেট ভরলেও মন যেন আরও বেশি ভরেছিল সেই সরল অথচ পরিপূর্ণ আয়োজন আর গ্রামীণ ভালোবাসায়। কেউ হাসতে হাসতে বলেছিল — "এই স্বাদের ডাকেই তো মানুষ বারবার ফিরে আসে গ্রামে!"
বিকেলের নরম আলোয় সবাই হাঁটতে বেরোল। সহজ কথাবার্তা, কুয়োর ঠাণ্ডা জল আর প্রাণখোলা হাসির ফোয়ারায় সময় যেন থমকে গিয়েছিল। ঠিক তখনই লালন হাসিমুখে এগিয়ে এল একটি প্রস্তাব নিয়ে —
"চলো, নৌকায় ঘুরতে যাই!"
ইছামতি নদীর ধারে তখন পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো। নদীর বুক জুড়ে শান্ত জলরাশি, আর নৌকার দোলায় সৃষ্টি হলো এক স্বপ্নঘেরা পরিবেশ। লালন কখনো পাটিসাপটা পিঠা এগিয়ে দিচ্ছিল, কখনো সবার জন্য পানি। তার মুখের হাসিটা ঠিক নদীর জলের মতো — স্বচ্ছ, শান্ত।
সূর্য পশ্চিম আকাশে নরম হয়ে হেলে পড়ছিল। নদীর জল সোনালি আলোয় ঝিকমিক করছিল। সবাই তখন চুপচাপ, যেন এই মুহূর্তটাকে কোনো শব্দে ভাঙতে না চায়।
ফেরার আগে রায়হান শেষবারের মতো চোখ ভরে নিল নদীর বাতাসে মেশা গন্ধ, পাখির ডাক আর বিকেলের শান্ত সৌন্দর্য। গাড়িতে ওঠার সময় সে আস্তে করে বলল — "জীবনের আসল সুখ বুঝি এতটাই সহজ — কিছু মুহূর্ত, কিছু মানুষ, আর নিখাদ ভালোবাসা। এই স্মৃতিগুলোই তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।"
ঘরে ফিরে আসার গাড়ি চলতে শুরু করল। পেছনে রয়ে গেল শীলবাড়ি, ইছামতির শান্ত নদীপথ আর সবাইকে হাসিমুখে বিদায় জানানো লালন।
সেই দিনের স্মৃতি রেখে মন্তব্যের খাতায় রায়হান লিখল —
"শীলবাড়ির হেঁশেলে ভোজন আর ভ্রমণ এক অদ্বিতীয় সংমিশ্রণ — যেখানে অতীতের গল্প আর সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে হৃদয় ভরে যায়। একদিনের এই ছোট্ট সফর হয়তো শেষ, কিন্তু এই স্মৃতি থাকবে অম্লান।"
Comments