জন্মই তার আজন্ম পাপ

দাউদ হায়দারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৮৫ সালে, কলকাতায়। আবৃত্তিলোকের সপ্তাহব্যাপী কবিতা উৎসবে যোগ দিতে ঢাকা থেকে অনেকেই তখন আমরা কলকাতায়। আমার জানা মতে, স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের কোনো বড় সাহিত্যের অনুষ্ঠানে সেই প্রথম শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও নির্মলেন্দু গুণসহ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কবি-লেখক শামিল হয়েছেন।
'বাংলাদেশের কবিতা' শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে তিনি কবিতাও পড়েন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, দাউদকে এখন পশ্চিমবঙ্গের কবি বললেই সুবিধে।
দাউদ ভাই কবিতা পড়ার আগে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সকলের সঙ্গেই কুশল বিনিময় করছিলেন। কথায় কথায় বলছিলেন, আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, আর, মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলছি। হুবহু নয়, কিন্তু এমন একটা কথাই তিনি বলছিলেন। তার মুখে হাসি থাকলেও তার চোখ ছিলো অশ্রুসিক্ত। পরে আমার সঙ্গেও অনেকক্ষণ কথা হয়েছিলো। কী কথা হয়েছিলো, আজ আর মনে পড়ে না। তবে, সেই সূত্রে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা থেকেই যায়। নব্বইয়ের দশকে ইমেইলে তো যোগাযোগ ছিলোই, কথা হতো ফোনেও। সব সময় তিনিই ফোন করতেন। কথা বলতেন দীর্ঘক্ষণ ধরে। কারা ভালো লিখছেন, সেই খবর নিতেন। আমার সম্পাদিত কাগজ 'নতুনধারা'য় লিখেছেনও মাঝেমধ্যে।
কবি হিসেবে তিনি কেমন কবি ছিলেন, কতোটা কবি ছিলেন, সেই আলোচনা এখন আর মুখ্য নয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি দৈনিকে ছাপা হয় তার 'কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়' নামের একটি কবিতা। স্বাধীনতার মাত্র দু' বছরের মাথায়ই এই কবিতার একটি পঙক্তি রচনার জন্য তাকে দেশ ছাড়তে হয়। কথাটা ঠিক করে বলতে হলে বলতে হয়, তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়।
তিনি প্রথমে কলকাতা যান, পরে সেখান থেকে ১৯৮৭ সালে জার্মানিতে। গতকাল তিনি সেখান থেকেই পরলোকবাসী হয়েছেন!
ভাবা যায়, কবিতার একটা পঙক্তির জন্য তাকে মাত্র ২২ বছর বয়সেই দেশছাড়া হতে হয়েছিলো এবং জীবনের প্রায় ৫১ বছর তাকে কাটাতে হয়েছে প্রবাসের নিঃসঙ্গ জীবন!
এমন দেশে জন্ম নেয়াটাই যে পাপ- এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ২২ বছর বয়সেই!
এ দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়াটাই কেবল পাপ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু চুরি, লুটতরাজ, ঘুষ, দুর্নীতি, ওষুধ বা খাবারে ভেজাল দেয়া, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা- সকলই সম্ভবত পূণ্যের কাজ! কারণ এসব বিষয়ে রাষ্ট্র যেমন চুপ, তৌহিদি সমাজও।
হয়তো দাউদ হায়দার পাপীই ছিলেন, যে কারণে ৫১ বছর, এমনকি মৃত্যুর পরেও নিজের দেশের মাটি তার কপালে জোটেনি! নিশ্চয়ই আমরা, এ জাতির বাকি সকলেই পূণ্যবান!
Comments