বাংলা নববর্ষ কীভাবে বাঙালির প্রাণের উৎসবে রূপ নেয়?

বাঙালি জীবনের অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন একটি উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষবরণের দিন। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় এই নববর্ষ। ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেয় নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্র করে তার স্বাতন্ত্র্য জীবনবোধে, স্বকীয় সংস্কৃতিতে। কারণ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, ক্ষুদ্র নৃজাতি সকলেই নির্বিশেষে যোগ দিতে পারে এমন উৎসব একটাই। আর সেটা হলো ১লা বৈশাখ।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিনটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই উৎসবটি গান, শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল "শুভ নববর্ষ"। নববর্ষের সময় বাংলাদেশে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো "মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" হিসেবে ঘোষণা করে।
শাড়ি আর পাঞ্জাবি ছাড়া যেন এ দিনটি চলেই না। বর্নিল সাজ আর হাতে গালে নানা রঙের ফুলকি আঁকা এখন হালফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরই বাড়ছে বর্ষবরণের এই বর্ণাঢ্য আয়োজন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সরাসরি সম্প্রচার, রমনার বটমূল থেকে পুরো ঢাকা হয়ে প্রতিটি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে পালন করা হয় এই উৎসব। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখি মেলার। পান্তা-ইলিশ, বাঁশি, ঢাক-ঢোলের বাজনা আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় পূর্ণতা পায় দিনটি।
এবার একটু ফিরে দেখা বাংলা নববর্ষের সূচনার ইতিহাস। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল 'ফসলি সন', পরে "বঙ্গাব্দ" বা 'বাংলা বর্ষ' নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। কারণ, কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মোঘল সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সন গণনা শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় বাংলা সন।
একসময় বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। যা ছিল পুরোপুরি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরোনো হিসাবনিকাশ নিষ্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষ্যে তারা নতুন-পুরাতন ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টান্ন ভোজন করাতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়ে আসছে।
কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। ষাটের দশকের শেষে বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনের মাধ্যমে। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যাণে ভোরে রমনার বটমূলে শুরু হওয়া বর্ষবরণের অনুষ্ঠান উপভোগ করে সারাদেশের কয়েক কোটি বাঙালি। সুর্যোদয়ের সাথে সাথে ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় বৈশাখকে বরণ করা হয়। অন্যদিকে ধানমন্ডি সরোবরে সুরের ধারা সংগঠনও বিভিন্ন পরিবেশনার মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করে নেয়। এদিন সকাল থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্ত কনসার্ট, বাউল, লালন, জারি-সারি, মুর্শিদি গানের আসর। ব্যান্ড দলগুলোও কনসার্টের আয়োজন করে। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা এখন 'বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযোত্রায়' রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে এ শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এখানে পশুপাখির মুখাকৃতির ছবিসহ বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয়। নানা রং-বেরঙের মুখোশ তৈরি ও আলপনা আঁকা হয়। ছেলে-বুড়ো সবাই তখন মেতে উঠে বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার আনন্দে।
বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পান্তা-ইলিশ। যেন পান্তা-ইলিশ না হলে পহেলা বৈশাখের কোনো আমেজই থাকে না। ঘরে ঘরে পান্তা ইলিশ আয়োজনের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার আয়োজন করা হয়। রমনার লেকের পাড়েও অনেকে বসে পড়েন ইলিশ-পান্তা খেতে। সঙ্গে থাকে কাঁচামরিচ। বছরে একটি দিন হলেও সবাই যেন এদিন বাঙালিয়ানার পরিচয় দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বৈশাখ মাস বলতে তো মেলার মাসকেই বোঝায়। একসময় শুধু গ্রামগঞ্জে মেলা হলেও এখন এর পরিধি বিস্তার লাভ করেছে শহুরে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট, মাঠে। তবে পার্থক্য থাকে গ্রামের আর শহুরে মেলায়। বৈশাখি মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়তে চায় অনেক শিশুই। বাঁশ-বেতের তৈজস আর নানা জাতের খেলার সামগ্রী, নারকেল মুড়কি, বাতাসা, মুরালিসহ আরো কত কী থাকে এসব মেলায়, তার ইয়ত্তা নেই। মেলার সময়ে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, কুস্তির আসর বসে। বিভিন্ন লোক সঙ্গীতের আসরও বসে।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলিখেলা। আর বর্ষবরণের এ মেলা প্রবাসীদের জন্য হয় মিলনমেলা। দীর্ঘ ব্যস্ততার অবসরে বৈশাখি মেলা প্রবাসী বাঙালিদের দেয় অফুরন্ত আনন্দ। দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালিরাও বৈশাখি মেলার আয়োজন করে থাকে। এভাবেই ১লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ একসময় বাঙালির প্রাণের উৎসবে রূপ নেয়।
রুবাইয়াত রিক্তা
গণমাধ্যমকর্মী
Comments