রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ভিত্তিহীন উচ্চাশা

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর একবার দেখা হিয়েছিল,এখন আবার থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুসের অংশ গ্রহণের সময়ও আওয়াজ উঠল যে রোহিঙ্গারা তাদের দেশ মিয়ানমারে ফিরছে। সামাজিক মাধ্যম তো আছেই, কিছু গণমাধ্যমেও বলা শুরু হলো যে, রোহিঙ্গারা আগামী বছরের মধ্যে স্বদেশে ফিরবে। কিন্তু এটি যে এত সহজ নয় সেটা অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে তিনি বলেছেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মি যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, এর ফলে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না যে আগামী বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে পারব কি না।'
হঠাৎ সামাজিক মাধ্যম ছয়লাব হয়ে যায় যে, ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা-কে ফেরত নিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ গত শুক্রবার বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় মিয়ানমার জানায়, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া তালিকাভুক্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে ফেরত যাওয়ার যোগ্য।
এই যোগ্য কথাটির মধ্যে যে বিশাল ফাঁক রয়েছে এটি বুঝতে না পেরে বিশাল হাইপ তৈরি করা হয় প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছিল। সেই তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই করে তারা একটা সংখ্যা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে।
পুরনো ও নতুন মিলিয়ে বাংলাদেশে আনুমানিক ১৪ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ২০১৮-২০ সালে বাংলাদেশ ৮ লাখ রোহিঙ্গাদের তালিকা মিয়ানমার সরকারের কাছে প্রত্যাবাসনের জন্য দিয়েছিলো। সে সময় তারা ভ্যারিফিকেশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে বলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিলো। বাস্তবতা হচ্ছে, এত সময় পরেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে এখন যে ১ লাখ ৮০ হাজার যোগ্য রোহিঙ্গার কথা বলা হচ্ছে এটিও মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নতুন কৌশল।
রোহিঙ্গারা যে রাখাইন স্টেইট থেকে এসেছে, তার ৯০ শতাংশ অঞ্চল এখন সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেখানে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সামরিক সরকারের কোন অবস্থানই নেই। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এটি মিয়ানমার বলার জন্য বলেছে। মিয়ানমারের নিজস্ব সিস্টেমও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া এক দুরূহ কাজ। এই যে যাচাই করা হচ্ছে, এটি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে না। তাদের রেসিডেন্সি নিশ্চিত করে। রোহিঙ্গারা তাদের মূল আবাসভূমিতে নাগরিক হিসাবে ফিরতে চায়। কিন্তু মিয়ানমার তাদের অন্য জায়গায় রাখতে চায়। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিকই বলছে না, বলছে তারা সেখানে ছিল। আর এ কারণেই এর আগে তিনবার তাদের প্রত্যাবাসন চেষ্টা সফল হয়নি এবং এবারও হবে না।
অনেকেই বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে বাংলাদেশকে এখন আরাকান আর্মির সঙ্গে আলাপ করতে হবে। আরাকান আর্মি যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে তারও নিশ্চয়তা নেই। বলতে গেলে আরাকান আর্মি রাখাইনের কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ায় প্রত্যাবাসন আরও জটিল হয়েছে। কারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নীতিগতভাবে চায় না আরাকান আর্মি। বাংলাদেশ এক দশক আগ থেকেই আরাকান আর্মির যোগাযোগ করছে। দীর্ঘ এই যোগাযোগের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ সরকার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বুঝতে পেরেছেন যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরাকান আর্মির কোন স্বদিচ্ছা নেই। তারা এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোন পরিকল্পনা জানায়নি। সবচেয়ে বড় কথা আরাকান আর্মি মনে করে রোহিঙ্গারা 'বাঙালি', 'রোহিঙ্গা' নয়।
বাস্তবতা হলো মুখে যাই বলুক, মিয়ানমার জান্তা সরকারের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রত্যাশা একেবারেই অসম্ভব।
Comments