বিপ্লবের কথা যারা বলছেন, তাদের উচিত সরকারে না থেকে বিপ্লবী দল তৈরি করা: ফখরুল

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের রাজনীতি ও সার্বিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে দেশ।
গণঅভ্যুত্থান, দেশের বর্তমান রাজনীতি, রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাসহ নানা বিষয় নিয়ে বলেছেন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের মহাসচিব হিসেবে আপনার কাছ থেকে বর্তমান সময়ের রাজনীতি সম্পর্কে বুঝতে চাই। একটি সফল গণঅভ্যুত্থান হলো এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের কাছে আপনারা একইসঙ্গে 'দ্রুততম' ও 'যৌক্তিক' সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছেন। এই 'দ্রুততম' ও 'যৌক্তিক' সময় বলতে কী বুঝাচ্ছেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: ১৫ বছরের বেশি সময়ের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ফলে বাংলাদেশের ব্যুরোক্রেটিক স্ট্রাকচার, রাজনৈতিক স্ট্রাকচার একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলার জন্য যেসব বিষয় দরকার, যেসব ইনস্টিটিউট দরকার, তার সবই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাটা অনেক বেড়েছে। তার মধ্যে প্রধান প্রত্যাশা হচ্ছে, এই সরকার একটি সুন্দর নির্বাচন দেবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের মতামত প্রকাশ করে নিজেদের একটি সংসদ ও সরকার গঠন করবে। আরও একটি প্রত্যাশা আছে—অতীত অভিজ্ঞতার কারণে যত জঞ্জাল আছে, তার সবই দূর করতে হবে।
প্রশ্ন: যেটাকে সংস্কার বলা হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল: হ্যাঁ। এসব জঞ্জাল দূর করার জন্য কতগুলো সংস্কার প্রয়োজন। বিষয়টি আমরা আগেই অনুধাবন করেছি। দল হিসেবে আরও দুই বছর আগে আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। সেখানে প্রতিটি বিষয়ে সংস্কারের উল্লেখ করা আছে। এমনকি রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের কথা বলা আছে।
এ কারণেই এই সরকার যখন সংস্কারের বিষয়টি সামনে এনেছে, আমরা কোনো আপত্তি করছি না। তবে, আমরা বলেছি, এই সংস্কার হতে হবে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে।
প্রশ্ন: যৌক্তিক সময় বলতে কত সময়?
মির্জা ফখরুল: প্রশ্ন হচ্ছে, যৌক্তিক সময় কী? নূন্যতম কয়েকটি বিষয় আছে। যেমন ধরেন—নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করে সুষ্ঠু নির্বাচন উপযোগী করতে হবে; সম্পূর্ণরূপে দলীয়করণ করা আমলাতন্ত্রকে সংস্কার করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে; বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছিল, সেটা যতটা সম্ভব সংস্কার করতে হবে। পুরোটা হয়তো ঠিক করা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ, যারা নিচের দিকে আছে, সেখানে কিছু কিছু থেকে যেতে পারে। এই বিষয়গুলো খুব জরুরি।
প্রশ্ন: যৌক্তিক সময়ের বিষয়ে চমৎকার কথা বলেছেন আপনাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। তাড়াহুড়োর ইঙ্গিত তিনিও দেন নি।তবে বিএনপির অন্য নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, মার্চ-এপ্রিলে নির্বাচন চান। এসব নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বিএনপির সুনির্দিষ্ট অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল: আমরা কোনো নির্দিষ্ট সময়-তারিখ বলতে চাই না। কারণ, দলীয়ভাবে আমরা বাস্তববাদী চিন্তা করছি। কাজেই এর জন্য সময় একটু এদিক-ওদিক হতেও পারে। কিন্তু, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনটা হতে হবে। সেটা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভালো।
আমরাও একসময় সরকারে ছিলাম এবং এখন সংস্কারের প্রস্তাবও দিয়েছি; তাই এটা বুঝি যে এর জন্য কিছুটা সময় লাগতে পারে। সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনের তারিখ দেওয়া সম্ভব না।
তারপরও তাড়াতাড়ি নির্বাচনের তারিখ দিতে বলছি কারণ, এর মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার আসবে। নির্বাচিত সরকার ও অন্তর্বর্তী সরকারের লিজেটিমেসি এক না। নির্বাচিত সরকারের ক্ষেত্রে জনগণের ম্যান্ডেট থাকে, অফিসিয়ালি থাকে। বিপরীতে আমাদের যখন বিদেশিদের সঙ্গে, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে, শিল্পপতিদের সঙ্গে কথা হয়, তারাও মনে করেন যে দ্রুত নির্বাচন হলে বিনিয়োগের বিষয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। বিনিয়োগকারীরা একটি অস্থায়ী সরকারের সময়ে বিনিয়োগ করতে সাহস পায় না।
প্রশ্ন: আপনি নির্বাচিত সরকার এবং জনগণের ম্যান্ডেটের কথা বলছেন। অতীতের দিকে যদি তাকাই, নির্বাচিত সরকারগুলোর কথা বলি—অন্তত ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত সরকারগুলোর কথা—সেখানে কী সংস্কারের ক্ষেত্রে খুব ইতিবাচক কিছু দেখতে পাই?
মির্জা ফখরুল: ইতিবাচক অবশ্যই বলব। সংস্কারের ক্ষেত্রেও কিছু ইতিবাচক বিষয় হয়েছে। একদলীয় ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থা এসেছে; বহুদলীয় ব্যবস্থায় সংসদীয় সরকার গঠন হয়েছে। হ্যাঁ, এটা চর্চা করতে পারেননি। কারণ, গত সরকার গণতন্ত্রের চর্চা করতে দেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে একটা বড় ক্ষতি করেছে। এটাই আজকের সংকটের মূল জায়গা। আমি খুব ভালো করেই জানি যে নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। কিন্তু নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রধান ফটক। সেখান দিয়ে প্রবেশ করেই আপনি গণতন্ত্রের পথে যাবেন। যদি জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া সরকার না থাকে তাহলে সংস্কার মানুষের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয় না। একটি নির্বাচিত সরকারের যে শক্তি ও সাহস থাকে, সেটা কখনোই একটি অন্তর্বর্তী সরকারের থাকবে না।
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকার, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের জনগণের ম্যান্ডেট আছে নাকি নেই, সেই জায়গায় যদি প্রশ্ন এভাবে আসে যে, একটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, যেখানে নামে না থাকলেও বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল; সেই অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারের প্রতি অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট, অর্থাৎ জনগণের ম্যান্ডেট তো আছে।
মির্জা ফখরুল: অভ্যুত্থানের যে লক্ষ্যগুলো ছিল, তার মধ্যে সংস্কার নিশ্চই আছে। কিন্তু, তার অর্থ এই নয় যে ওয়ান-ইলেভেনের মতো বা অন্যান্য সময়ের মতো দু বছর, চার বছর বা ছয় বছর এই সরকার চলবে। কখনোই একটি অনির্বাচিত সরকারের যৌক্তিক সময়ের বাইরে যাওয়া উচিত না। এতে নানা ধরনের সমস্যার তৈরি হয়। বিদেশিদের সঙ্গে এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয় সেটাও বলেছি। একইসঙ্গে বাংলাদেশ যারা ফ্যাসিবাদের সমর্থক, গণতন্ত্রেরবিরোধী শক্তি, তারা এই সময়ের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দেখেন, তারা সংস্কার করতে গিয়ে সেটা সম্পন্ন করতে পারলো না। বাধ্য হয়ে নির্বাচন দিয়ে তাদের বেরিয়ে যেতে হলো।
প্রশ্ন: ওয়ান-ইলেভেনের দুঃস্বপ্ন বা দুর্ভাবনা আপনারা কেন বারবার মাথায় আনছেন?
মির্জা ফখরুল: কারণ, ওয়ান-ইলেভেন আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে।
প্রশ্ন: কিন্তু, ওয়ান-ইলেভেনের সরকার গঠনের ধরন আর এই সরকার গঠনের ধরন তো এক না।
মির্জা ফখরুল: কিছুটা মিল আছে। এটাও নির্বাচিত সরকার না। এখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব নেই। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, জনগণের প্রতিনিধিত্ব কারা করে। শুধুমাত্র বিএনপি করে না, শুধুমাত্র ছাত্রদের একটি গ্রুপ করে না; অথবা এই আন্দোলনের যারা নেতৃত্ব দিলো শুধুমাত্র তারাও করে না। জনগণের প্রতিনিধিত্ব তারাই করে, যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসে। এটা শুধু কথার কথা না, বাস্তবতা। যেসব দেশে গণতন্ত্র ভালো ভাবে চলছে, সেসব দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ, তারা গণতন্ত্রের চর্চা করে। আমরা এখানে গণতন্ত্রের চর্চাই করতে পারিনি। আর যখনই একটি অনির্বাচিত সরকার আসে, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের অ্যাম্বিশন তৈরি হয় আরও কিছু সময় থেকে তারপর চলে যাওয়ার। যার জন্যই আমরা বারবার ওয়ান-ইলেভেনের কথা বলি।
প্রশ্ন: প্রাসঙ্গিকভাবেই আরেকটি প্রশ্ন আসে। এই আন্দোলনেরও আগে স্কুল শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলন করেছিল। সেখানেও আপনারা সমর্থন দিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন। এবারের আন্দোলনের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার যখন সংবিধান সংস্কার করতে চাইছে, সংবিধান পুনর্লিখন করতে চাইছে, সেটা নিয়ে নিশ্চই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সংবিধান সংস্কারের এই জায়গায় সরকারের সঙ্গে আপনাদের মতের মিল হচ্ছে না। সেটা কেন? আপনারা কেন সংবিধান সংস্কার করতে চাইছেন না?
মির্জা ফখরুল: আমরা সংস্কার চাইছি না সেটা বলিনি। আমরা বলেছি, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হবে। আপনি যদি নিয়ম না মানেন, তাহলে অনিয়ম চলতেই থাকবে। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার এই সংবিধান মেনে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে। এর জন্য আপিল বিভাগের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়েছে। অর্থাৎ, সংবিধান কিন্তু বলবত। এই সংবিধান যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে প্রশ্ন আসবে কারা এটা করার জন্য যোগ্য। সবসময় একটি কথাই আসে, জনগণই হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক। স্পষ্ট বলা আছে, জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করা হবে। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সংসদই সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক এবং সংসদীয় কমিটি এগুলো করবে। এখানে অন্য কোনোভাবে দেশ পরিচালনার সুযোগ নেই। আপনি সেটা চর্চা করেন না, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু, এটাই চর্চা করা উচিত। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এটা চমৎকার ভাবে কাজ করছে।
এখন আমাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকম। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই শুরু হয়েছে লিগেসি, যেটা হচ্ছে গণতন্ত্র ধ্বংস করা। পরবর্তীতে বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। খুবই দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেখ মুজিবের হাতেই গণতন্ত্র ভেঙে দিয়ে বাকশাল হয়েছে। এর পরবর্তীকালেও গণতন্ত্রকে ঠিকভাবে চলতে দেওয়া হয়নি। সেই সংস্কৃতিই গড়ে ওঠেনি।
প্রশ্ন: গণতন্ত্রের সংস্কৃতির কথা বলছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি সারা জীবন রাজনীতি করলেন, দেখলেন। দেশে হাজারো মানুষকে হত্যা করে, একটি গণহত্যা চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের বিষয়ে বলব না। বিএনপির কথা বলি। বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল, ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া দল। এই দলের ভেতরে কি গণতন্ত্রের চর্চা আছে? বা যেমনটি প্রত্যাশা করা হয় তেমন গণতন্ত্র আছে?
মির্জা ফখরুল: পুরোপুরি আছে, সেটা আমি বলব না। কিন্তু, আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করছি। আমাদের কাউন্সিল হচ্ছে। আমাদের স্থায়ী কমিটির মিটিং প্রতিমাসে চারবার হয়। অর্থাৎ, এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত ভাইস চেয়ারপারসন নিচ্ছেন না। তিনি সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। গণতান্ত্রিকভাবেই দলটিকে পরিচালনা করার জন্য সব উদ্যোগ নিচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সব জায়গায় কাউন্সিল আমরা করতে পারিনি। সেটাও হবে।
আগেও বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের উদ্যোগটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে থাকলে গণতন্ত্রের চর্চা গড়ে উঠছিল। দেখেন, গত তিনটি নির্বাচনে জবাবদিহি কতটা ছিল। গত ১৫ বছরে সংসদে কোনো বিতর্ক হতো না। তার আগে হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতি নির্ভর করবে দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপরে। সেই জায়গাটা আমাদের সবাইকে মিলেই ঠিক করতে হবে।
প্রশ্ন: ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালের নির্বাচনকে নির্বাচনই হয়ত বলা যায় না। সেখানে না গিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। কারণ, বারবার এই প্রসঙ্গ সামনে আসে—আমরাও বলি, রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনারাও বলেন। এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়ান-ইলেভেন তৈরি হওয়াটাও কি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা নয়?
মির্জা ফখরুল: এর দায় অস্বীকার করব না। কিন্তু, তার প্রেক্ষাপটটা চিন্তা করতে হবে, কেন ওই সময়ে ঘটনাটা ঘটলো? ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের ঘটনা ঘটেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুরো বিশ্বের রাজনীতিতে একটা পরিবর্তন এসেছে। সেটা হচ্ছে—এই যুদ্ধ ও সন্ত্রাস নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের একটা নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেও একটা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। খেয়াল করলে দেখবেন, পশ্চিমা কূটনৈতিকরা ওয়ান-ইলেভেনের আগে খুব অ্যাকটিভ হয়ে গিয়েছিল। তারা একটা ক্লাবও তৈরি করেছিল। পশ্চিমা যারা ছিলেন তারা সেখানে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন মিশনে কাজ করে। ফলে, অনেক কিছুই তাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু, ক্ষমতা দখল না করে তারা যদি নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করার জন্য কাজ করত, তাহলে ভিন্ন কিছু হতো। ফখরুদ্দিন সাহেবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি একজন আমলা। রাজনীতি সম্পর্কে তিনি কি জানেন? যারা রাজনীতি জানেন না, তাদের মাধ্যমে দেশ চালালে গণতন্ত্র পাবেন না।
প্রশ্ন: বর্তমান সরকারকে কীভাবে দেখছেন?
মির্জা ফখরুল: একটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই সরকার এসেছে। আমরা সমর্থন দিচ্ছি। তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, কথা বলছেন। ভুল-ত্রুটি করছেন, সেইসঙ্গে সেটা শুধরানোর চেষ্টাও করছেন। তারা সংস্কারের জন্য কাজ করছেন। সেই সময়টুকু আমরা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমরা সংস্কার করে নির্বাচনে যাবো। তারা এটাও বলছেন, সংস্কার করে নির্বাচন দেওয়ার অর্থ পাঁচ-ছয় বছর ক্ষমতায় থাকা নয়। তারাও একটা সময়ের কথা বলছেন, হয়তো আপনাদের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট করে মিলছে না।
মির্জা ফখরুল: সময় নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের তিনবার দেখা হয়েছে। তাকে আমরা বলেছি, আপনাদের যথেষ্ট সময় দিতে রাজি আছে, কিন্তু সেটা যৌক্তিক সময় হতে হবে।
প্রশ্ন: বর্তমান সরকার নির্বাচন দেবে না এমন কোনো শঙ্কা আপনাদের মধ্যে আছে? বা এমন কোনো শঙ্কা তৈরির কোনো কারণ আছে?
মির্জা ফখরুল: আমি আপাতত দেখছি না। অফিসিয়ালি ছাড়াও আনঅফিসিয়ালি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই আমার মনে হয়নি যে তারা নির্বাচন দেবে না বা নির্বাচন দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিলম্ব করবে।
প্রশ্ন: অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা কিছু কথা তুলতে চাই। আপনাদের কাছে কি কোনোভাবে মনে হয় যে বিএনপিকেও মাইনাস করার চেষ্টা করা হবে?
মির্জা ফখরুল: এমন কথা আছে, আমরাও দু-একবার বলেছি। এই শঙ্কাগুলো এসেছে কোথা থেকে? যখন দেখি মূল বিষয়গুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভুল-ত্রুটি হচ্ছে, তখন শঙ্কাগুলো আসছে। যেমন: সংস্কারের জন্য কমিটি গঠনের আগে আমাদের সঙ্গে একটু আলোচনা করা হলে খুশি হতাম। এসব কারণে কিছুটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা বলেছিলাম, নির্বাচন পরিচালনার যে আইন আছে সেটা স্থগিত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সর্বজন বিদিত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক। সেটা না করে তারা সার্চ কমিটি করলেন এবং নাম চেয়েছেন। সার্চ কমিটির অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো না। আমরা নাম দিয়েছি, কিন্তু দেখা গেছে যে তারা সব সরকারি লোকজনকে দিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনারা তারপরও নাম দিয়েছেন?
মির্জা ফখরুল: আমরা দিয়েছি। সরকারকে আমরা সবসময় সহযোগিতা করছি। কিন্তু, একইসঙ্গে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তাদেরকে সবসময় সতর্ক করছি। তাদের বলছি, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে। যাতে একই ধরনের সমস্যা তৈরি না হয়। ড. ইউনূসের সরকারের কাছ থেকে আমরা সেটাই আশা করব। তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ—শুধু দেশে নয়, গোটা বিশ্বে। প্রথম দিনই তাকে বলেছিলাম, আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশ; সেই প্রত্যাশা যদি কমতে থাকে, বা ফল যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আপনি আপনার প্রতি অবিচার করবেন। কাজেই সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত করা। সবাইকে সম্পৃক্ত যখনই করবেন না, তখনই দেখবেন শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। অল্প সময়ের আলোচনায় সব বলা যায় না। তাই আমরা মনে করি, ঘন ঘন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসা উচিত।
আমরা দেখছি, আলী রীয়াজ সাহেব রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিচ্ছেন। আমরা এখনো পাইনি, হয়তো পাব। তারা চাচ্ছেন, আমাদের প্রত্যাশাগুলো তাদেরকে লিখিতভাবে জানানোর জন্য। এটা ভালো। লিখিতভাবে জানাবো আমরা। কিন্তু, একই সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
প্রশ্ন: আপনারা জানাতেও চান, জানতেও চান।
মির্জা ফখরুল: হ্যাঁ। আমরা লিখিতও দিবো। তারপর যে পরিবর্তনগুলো আসবে, সেটা কি আমাদের সঙ্গে আলাপ না করে করবে? যদি দেখা যায় যে বড় কোনো সমস্যা হয়েছে! এর একটা ফান্ডামেন্টাল ব্যাপার আছে।
অনেকে বলেছেন, সংবিধান কী? গণঅভ্যুত্থানই সংবিধান। কিন্তু, কারা এটা করবে? সংবিধানটা আনতে হলে তার একটা ম্যান্ডেট থাকতে হবে, এখতিয়ার থাকতে হবে।
একটা প্রশ্নের উত্তর দেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান কোটি কোটি মানুষ করেছে। কার কাছ থেকে আপনি এটা নিবেন? সরকারে এসেছেন তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি। তারাই কি শুধু প্রতিনিধি? এর বাইরেও আরও প্রতিনিধি আছে আমরা দেখছি। তারা অনেক রকম কথা বলছেন। তারা দাবি করছেন, ছাত্র সমন্বয়কারীরা দল করতে চাচ্ছেন। সেটা ভালো কথা। সেটাও তো আমাদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে। সমন্বয়কদের যারা সরকারে আছেন তাদের বিষয়টিও আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকছে।
প্রশ্ন: আপনারা যখন আলোচনা করতে গিয়েছেন, তখন কি এ বিষয়ে কথা বলেছেন?
মির্জা ফখরুল: হ্যাঁ, বলে এসেছি।
প্রশ্ন: সরকারের পক্ষ থেকে কী বলা হচ্ছে, সেটা কি শুনে এসেছেন?
মির্জা ফখরুল: না, এটা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি।
প্রশ্ন: সরকারের ভেতরে সমন্বয়কদের যে প্রতিনিধিরা আছেন আর বাইরে যারা আছেন, তাদের মধ্যে কাদের কথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বক্তব্য সেটা বুঝতে চাইছেন আপনারা?
মির্জা ফখরুল: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: একই রকমভাবে সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয় যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও মহাসচিব কথা বলছেন, একইসঙ্গে দলের আরও অনেকে কথা বলছেন। কাদের বক্তব্য বিএনপির বক্তব্য হিসেবে ধরা হবে।
মির্জা ফখরুল: ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও মহাসচিব—আমরা দলকে প্রতিনিধিত্ব করি। আমরাই দলের বক্তব্য তুলে ধরব। অন্যরা অনেক কথা বলতেই পারেন। ছাত্রদের মধ্যে যারা সমন্বয়ক—তাদের মধ্যে যারা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন, আমরা ধরে নিবো তাদের কথাগুলো তাদের দলীয় কথা। সেইসঙ্গে এটাও ধরে নিবো যে সরকারের মধ্যে যারা আছেন, তারাও তাদের প্রতিনিধিত্ব করে।
একটি কথা খুব জোরালো ও পরিষ্কারভাবে বলতে চাই—তাদের (সমন্বয়ক) সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই, দূরত্ব নেই। আমরা তাদের সহায়তা করতে চাই, সরকারকেও সহায়তা করতে চাই। কিন্তু জনগণের ইচ্ছার বাইরে যাবে এমন কিছু আমাদের মেনে নেওয়া কঠিন হবে।
প্রশ্ন: জনগণের ইচ্ছা তাহলে কোনটা?
মির্জা ফখরুল: ওইটাই সমস্যা। জনগণের ইচ্ছা কোনটা সেটা কীভাবে বুঝবেন? এ জন্যই আমরা নির্বাচনের কথা বলছি। যদি নির্বাচন না করে কোনো পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আপনাকে গণপরিষদ করতে হবে।
প্রশ্ন: আপনারা নির্বাচনের কথা বলছেন, সরকারও সেটাই বলছে। আপনারা যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের কথা বলছেন, সরকার বলছে সংস্কারের পর নির্বাচন। কিন্তু সরকারও যে অনেক লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকতে চাইছে, তাদের প্রকাশ্য বক্তৃতায় তেমন কিছু পাচ্ছি না। তাহলে, বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সরকারের কথায় তেমন কোনো পার্থক্য তো দেখছি না।
মির্জা ফখরুল: না, পার্থক্য নেই। কিন্তু, কতগুলো মৌলিক বিষয় তাদের আরও স্পষ্ট করা দরকার। যেমন: কেউ কেউ বলছেন, সংবিধান পরিবর্তন নয়, আমরা নতুন করে লিখব। এমনকি সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রধান ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, সংবিধান পুনর্লিখন হবে। দিন শেষে সংবিধান পুনর্লিখন, নতুন করে তৈরি নাকি সংশোধন হবে, এটা এখনো পরিষ্কার না।
প্রশ্ন: এটা নিয়ে আপনাদের অবস্থান কী?
মির্জা ফখরুল: সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে আমরাও একটি কমিটি করেছি, সেটাও সরকারকে দেবো। সরকার চালানোর জন্য বর্তমান সংবিধানের যেটুকু সংশোধন প্রয়োজন সেটুকুতে আমরা সহযোগিতা করছি। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন আনতে চাইলে তার দায়িত্ব জনগণের কাছে। জনগণের প্রতিনিধিরা এটা করবে।
প্রশ্ন: অভ্যুত্থান তো জনগণ করেছে।
মির্জা ফখরুল: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যে জনগণ করেছে, তারা কারা? তাদের মধ্যে কাদের কাছ থেকে আসবে এই বক্তব্য?
প্রশ্ন: যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারা।
মির্জা ফখরুল: সেটা আপনি কীভাবে জানবেন? এটা অনেকে অনেক ভাবে বলছে।
প্রশ্ন: আপনারা এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন, হয়তো নামে ছিলেন না। কিন্তু, শিক্ষার্থীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেটা সারা পৃথিবী দেখেছে। সেটা পরিষ্কার?
মির্জা ফখরুল: আমরা সেটা অস্বীকার করছি না। আমরা এটাকে ওন করি। সেখানে আমরাও ছিলাম। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে বিশ্বের যেকোনো দেশে জনগণের ম্যান্ডেট লাগবে। আর এই সরকার তো বিপ্লবী সরকার না।
প্রশ্ন: সাংবিধানিক সরকারও তো না।
মির্জা ফখরুল: সাংবিধানিক সরকার এই হিসেবে যে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছেন। আমরা এই দেশে বহুবার পরিবর্তন দেখেছি। সেই আলোকে ওটাই একমাত্র পথ শুরু করার। এ জন্যই আমাদের মনে হচ্ছে তাদের সবকিছু আরও পরিষ্কার করা দরকার।
Comments