আরবরা কেন ফিলিস্তিনের পাশে নেই

গাজায় নিরীহ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর যেভাবে ইসরাইল হামলা করছে, যে নৃসংশতা করছে তা সহিংসতার সব ভাষাকে হার মানিয়েছে। শুধু মুসলমান নয়, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ আজ প্রতিবাদ করছে ইসরায়েলের বর্বরতার। কিন্তু একদিকে মিশর ও জর্দান এবং অন্যদিকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর দেশগুলো মুখ বন্ধ করে রেখেছে এই ইসরাইলি নিমর্মতায়। শুধু তাই নয় মিশর এবং সৌদি আরব ফিলিস্তিন পন্থী সব ধরনের সভা সমাবেশেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
মুসলিম দেশগুলোর এই আচরণ বিশ্বজুড়ে সাধারণ মুসলমানদের, এমনকি অমুসলিমদেরও ক্ষুব্ধ করছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে এই দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থার কিছু মৌলক বিষয় সামনে এসেছে। একটি হলো রাজনৈতিক আন্দোলনের ভয়। এই দেশগুলোতে কোনো গণতন্ত্র নেই। সাধারণভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা সবসময়ই বৈধতা সংকটে ভোগে। তাই এসব দেশের শাসকরা সাধারণ মানুষের যেকোন চাওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা মানুষের সক্রিয়তা এবং নাগরিক সংহতিকে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখে। যে কারণে ফিলিস্তিনিদের কেন্দ্র করে জনগণকে একত্রিত করে এমন ঘটনা তাদের পছন্দ নয়। বেশিরভাগ আরব সরকারগুলো এই ধরনের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, মানুষকে এসব থেকে বিরত রাখতে চায়।
বেশিরভাগ আরব দেশগুলোর শাসকদের জনপ্রিয় বিক্ষোভে অস্বস্তি আছে। তারা আশঙ্কা করছে যে জনসাধারণের জন্য ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতির প্রতিবাদের অনুমতি দেওয়া মানেই সরকার এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে উৎসাহিত করা। যেকোন ধরনের জনপ্রিয় সংহতি বা সক্রিয়তা যা মানুষকে একত্রিত করে, অনলাইনে বা রাস্তায় নিয়ে আসে, তা এই স্বৈরাচারী শাসনের জন্য হুমকি হিসেবেই বিবেচিত হয়। আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ পছন্দ করে না, কারণ ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ আগামী দিনে আরব দেশগুলোর রাস্তায় জনপ্রিয় জনপ্রত্যাশার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
আরব বিশ্ব তার নাগরিকদেরকে মূলত ভোক্তা হিসাবে পরিণত করেছে। একজন নাগরিক যা চান তা খেতে পারেন, পরতে পারেন। সারা পৃথিবীর যত ব্যান্ডেড ফুড আইটেম আছে, ফ্যাশন আউটলেট আছে, গাড়ি আছে সব পাওয়া যায় এসব দেশে। আরব শাসকরা চায় জনগণ তাদের সময়, অর্থ এবং চিন্তাভাবনা খাওয়া দাওয়া আর বিলাসিতায় ব্যয় করুক। রাজনৈতিক ক্ষমতা, জননীতি এবং অর্থনীতিসহ নীতিগত যা কিছু আছে সেগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে।
আরেকটি কারণ হলো ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতির ভয়। ফিলিস্তিনিদের ভয় করে আরব শাসকরা। এই একটি প্রশ্নে অনেক আরব সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ বের হয়ে আসে। আরব শাসকরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে প্রতীকী কিছু প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে তাদের জনগণকে দেখাতে হয় তারা দু:খিত, ব্যথিত। কিন্তু কোনো আরব রাষ্ট্রই ইসরাইলের মোকাবিলা করতে চায় না। তারা মনে করে,এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে।
তবুও গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা অব্যাহত থাকায় এই সরকারগুলোর উপর অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখন আরব দেশগুলো গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। এই আহবান যতটা ফিলিস্তিনিদের মঙ্গল কামনায়, তার চেয়ে বেশি নিজেদের শাসনের স্থিতিশীলতা, বৈধতা এবং এমনকি টিকে থাকার জন্য। প্যালেস্টাইন একটি ন্যায়সঙ্গত কারণ, এর বেশি ভাবতে চায় না এই দেশগুলো।
বেশিরভাগ আরব শাসক মৌলিকভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার অন্বেষণকে দমন করার এবং ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলের দখলকে স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টার সাথে জড়িত। এটি তারা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে ইসরাইল এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলির কাছ থেকে নিরাপত্তা, জ্বালানি এবং বাণিজ্যিক চুক্তির মতো ক্ষেত্রে ছাড় পেতে একটি দর কষাকষি হিসাবে ব্যবহার করেছে।
তাদের মাথায় আছে আরব বসন্তের কথা। আরব বিশ্বের শীতল যুদ্ধ-যুগের রাজনীতি এবং জনপ্রিয় আরব জাতীয়তাবাদীদের উত্থান এবং পরবর্তীতে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং ফিলিস্তিনি সংগ্রাম তাদের জন্য কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে সেই কারণগুলোও বিবেচনায় আছে তাদের। তারা মুসলিম শাসক, কিন্তু কোন ইসলামি আন্দোলন চান না। ফিলিস্তিনকে তারা নিজেদের ভূমিতে আগামী দিনে ইসলামি আন্দোলনের সূত্র হিসেবে দেখেন।
ফিলিস্তিন এমন এক ইস্যু যা স্বাধীনতা এবং মর্যাদার জন্য একটি বৃহত্তর সংগ্রামের প্রতীক, যা অনেক আরব এবং মুসলিম শাসকদের জন্য অস্বস্তিকর। ফিলিস্তিনের প্রশ্নটি একটি ন্যায্যতার বিষয়, কারণ তার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। সেই অন্যায়ের প্রশ্নটিকে এখন আরব জনগণ ন্যায়বিচারের সন্ধানের প্রতীক হিসাবে ব্যাখ্যা করে, যার মধ্যে আরব বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসনের সমালোচনা করাও অন্তর্ভুক্ত। আরব শাসকরা নিজেদের জনগণের মৌলিক অধিকারকেই যখন অস্বীকার করছে তখন কেমন করে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ায়?
লেখক: সাংবাদিক
Comments