ট্রাম্পের বিজয়: উচ্ছ্বাস উদ্বেগের কিছু নেই বাংলাদেশে
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশ পরিস্থিতির উপরে কী প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে সরব আলোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমে, টেলিভিশন টকশো-তে এবং নানা স্তরে। পত্রিকাগুলোতে কলাম লিখছেন, বিশেষজ্ঞ মতামতও লিখছেন অনেক সাবেক কূটনীতিক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা প্রবাসীরা।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সুলিখিত অভিনন্দন বার্তায় অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, 'ভবিষ্যতে আমাদের অংশীদারত্বকে আরও শক্তিশালী করতে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে উন্মুখ হয়ে আছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যেহেতু দুটি বন্ধুপ্রতীম দেশ একসঙ্গে নতুন অংশীদারত্বের পথ অন্বেষণ করছে, সেহেতু অসীম সম্ভাবনা রয়েছে'।
বাংলাদেশে যারা পতিত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন বা সমর্থন করে তারা উল্লসিত যে কমলা হ্যারিস জিতলে ড. ইউনূসের জন্য যতটা সুবিধা হতে পারত ততটা হবে না ট্রাম্প জেতায়। এরও একটি জবাব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, "প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের সাথে ডেমোক্র্যাট পার্টি, রিপাবলিকান পার্টি সবার সাথেই খুব ভালো সম্পর্ক আছে। তাদের টপ লিডারদের অনেকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব আছে এবং আমরা আশা করি, সেই সর্ম্পক আরো গভীরতর হবে"।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কি সত্যিই বড় কোন বিবেচনায় থাকবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের? আমার তা মনে হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনে যে বিশাল পৃথিবী, তার যে অগ্রাধিকার তালিকা তাতে একেবারে তলানিতেই থাকবে বাংলাদেশ। এখন যে প্রতিক্রিয়াটা বাংলাদেশে হচ্ছে তা মূলত মনস্তাত্বিক। একটা অংশ উল্লসিত কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের প্রচারণা কালে এক এক্স বার্তায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রসঙ্গ এনেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বর সহিংসতা চালানো হচ্ছে এবং তারা হামলা ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে। এমনটাও বলেছিলেন যে, 'এটা আমার নজরদারিতে থাকলে ঘটত না। কমলা ও জো (বাইডেন) সারাবিশ্বে এবং আমেরিকায় হিন্দুদের উপেক্ষা করেছেন'।
এটি ছিল তার প্রচারণা কৌশল। মূলত আমেরিকার হিন্দু এবং ভারতীয়দের মন জয়ের জন্যই এ কথা বলেছিলেন সেই দিন ট্রাম্প। বাস্তবে ট্রাম্পের হাতে খুব সময়ই থাকবে এসব নিয়ে ভাববার। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইজরায়েলে আগ্রাসন, ইরান-হেজবুল্লাহ-ইজরায়েল সমীকরণ এবং চীনের সাথে মার্কিন টানপোড়েন নিয়েই চলে যাবে তার দীর্ঘ সময়।
একটা দেশের মানুষই ঠিক করে সে দেশের রাজনীতির গতিপথ। অন্য দেশের কেউ আসলে কিছু করতে পারে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে সহযোগিতা ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতের। কিন্তু তারাও শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে পারেনি। এদেশের মানুষই বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে নিজেদের তাগিদে।
তবে কিছু চিন্তা তো আছেই আমাদের জন্য। ভারত কীভাবে এবং কতটা ট্রাম্পের প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে এবং সেখানে বাংলাদেশ কতটা স্থান পাবে সে ভাবনাটা আছে। তবে বেশি ভাবনা বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে। অনেকেই আশংকা করছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি অভিবাসী নীতি কড়াকড়ি করেন তাহলে আমাদের অভিবাসী যারা আছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এই বিপাকে পড়বেন।
আরেকটি শঙ্কার জায়গা হলো আন্তর্জাতিক মানবিকতা বা সহযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা হ্রাস করার পক্ষে। এ অবস্থায়, বাংলাদেশের জন্য মার্কিন উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা কমে যেতে পারে। এতে করে আমাদের অনেক বেসরকারি সাহায্য সংস্থা – এনজিওর তহবিল সংকট হয় কিনা সেটাও ভাবনায় আছে।
ট্রাম্প প্রশাসন চীনবিরোধী ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে জোর দেবে। নিরাপত্তা এবং সামরিক বিষয়ে কেন্দ্রীভূত এই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে সেটা নিয়ে সরকার নিশ্চয়ই ভাবছে।
বাংলাদেশে ট্রাম্পের পক্ষে বিপক্ষে যে প্রতিক্রিয়া সেগুলো এক কথায় অতিকথন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে যিনিই নির্বাচিত হন বা দায়িত্বে আসুন,তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের আচরণের তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। কারণ বড় কিছু বিশেয়ায়িত ইস্যু ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন আসে না। আর বিশেষ করে ছোট দেশগুলোর বেলায় তো একেবারেই না। বাংলাদেশে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় থাক, অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত থাক এবং গণতন্ত্র প্রক্রিয়া বজায় থাক—এই বিষয়গুলোতেই সব মার্কিন প্রশাসন প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
আসল কথা হলো আমরা নিজেরা কি করছি সেটাই বড় বিবেচনা। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নির্ধারণ করবে দেশের আগামীর পথ।
লেখক: সাংবাদিক