সোনাদিয়া লাল কাঁকড়ার দেশে...
প্রকৃতির এক স্বর্গ রাজ্য এবং ক্যাম্পিং এর পারফেক্ট ও জনপ্রিয় স্থান হল সোনাদিয়া দ্বীপ। নিস্তব্ধ, কোলাহলমুক্ত বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত, মনোমুগ্ধকর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত, দুরন্ত লাল কাঁকড়ার আতুঁরঘর, ঝাউগাছের বিশাল বন, বালি-কাঁদার মিলমিশ, রাতের শেয়ালের ডাক আর জোস্নার আলো-আধাঁরি খেলা সব মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপ যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি। যে ছবি আমাকে করেছে মুগ্ধ ও মাতালপনা।
গিয়েছিলাম ১৫ নভেম্বর ভরা পূর্ণিমায় সোনাদিয়া দ্বীপে ক্যাম্পিং করতে 'চলো দেশটা ঘুরি শেয়ারে' ফেসবুক ভিত্তিক ট্রাভেল গ্রুপের সঙ্গে। জীবনের স্মরণীয় একটা ট্যুর হয়ে স্মৃতির ডায়েরিতে গেঁথে থাকবে যা আমৃত্যু। কয়েকজন মজার ট্যুরমেট মিনহাজ, রাইহান, কায়েস, পল্লীশরি, সূচী, অশী মনি, মুহিত, আলমগীর, ফারুক, সাইফুল, আনাস ছিল ভালো লাগার অন্যতম কারণ।
সোনাদিয়ায় রাতে তাবুতে ক্যাম্পিং ছিল এটাই প্রথম, তাও জীবনসঙ্গীকে নিয়ে। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করেছে, যেটি লেখনিতে ধরে না। সোনাদিয়ার প্রকৃতির সৌন্দর্যের আঁধার ছড়ানো শুরু করেছে ঘটিাঙা ঘাটের বাঁশের সাঁকো থেকে। এরপরে ম্যানগ্রোভ বনের মাঝে খাল ধরে ইঞ্জিন নৌকার সরে সরে যাওয়, দুইপাশে সবুজ বনে ঘেরা কেওড়া, হারগোজা, উড়িঘাস আর সাদা কালো গাছের সারি। মহেশখালী থেকে একটি খাল হতে বিচ্ছিন্ন ৯ বর্গকিলোমিটার আয়নের এই দ্বীপজুড়ে রয়েছে তিন দিকে সৈকত, সাগর লতা ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া-নিশিন্দার ঝোঁপ, ছোট-বড় খালবিশিষ্ট প্যারাবন এবং বিচিত্র প্রজাতির জলজ প্রাণি ও পাখির সমারোহ। দ্বীপের চারদিকে যতোদূর চোখ যায় ততদূর মনে হয় পানি, আকাশ আর গাছের মিলনমেলা।
ভীষণ ভালো লাগছে সাগরের শীতল হাওয়া আর খালি পায়ে হেঁটে বেড়ানো। এখানে হাঁটার নিয়ম হলো একদম সাগরের কাছে তীর দিয়ে হাঁটতে হবে। নাহলে বালিতে পা ডুবে যায়। হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেলাম কাঙ্খিত লাল কাঁকড়া। এরা এত টক টকে লাল আর আর দ্রুত চলে, অনেকক্ষণ এদের ভিডিওই করতে পারছিলাম না। কারণ এরা দূর থেকেই পালিয়ে যায়। হয়তো টুক টুক করে ৪ পায়ে কার্টুন এর মত দৌড়ে সাগরে লাফ দিয়ে পড়ে অথবা টুক করে কোনো গর্তে ঢুকে পড়ে। শেষমেষ পেছন পেছন দৌঁড়ে সাফল্য। অনেক চেষ্টা করে আমি একটা লাল কাঁকড়া ধরলাম। লক্ষ্য করলাম, কাঁকড়ার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিলে সেটি তখন আমার সাথে না পেরে একসময় না পালিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তার অস্ত্র (দাঁড়) উঁচু করে তাকিয়ে ছিল! লাল কাঁকড়ার পাশাপাশি দেখা হয়ে যেতে পারে সামুদ্রিক কাছিমের সাথেও। সমুদ্র সৈকত এবং বালিয়াড়ি এই দ্বীপে শীতকালে বিপন্ন সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার উপযোগী স্থান।
চাঁদনী রাতের সৈকতের পাড়ে বালুকণায় রাতের ক্যাম্পিং এবং বারবিকিউ পার্টি আর দল বেঁধে গান- জীবনের সৌন্দর্য আর ভালোলাগা যদি খুঁজে পেতে চান চলে যেতে পারেন পরিবার, বন্ধু-বান্ধব মিলে...।
কীভাবে যাবেন?
সোনাদিয়ায় দুইটি উপায়ে যাওয়া যায়।
একটি হচ্ছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম দিয়ে সড়কপথে বাঁশখালি/চকরিয়া হয়ে বদরখালী পর্যন্ত যাওয়া। এস. আলম বাস চট্টগ্রাম থেকে বদরখালি রোডে প্রতিদিন চলাচল করে। বদরখালী থেকে সিএনজি টেক্সি করে মহেশখালী হয়ে ঘটিভাঙা ঘাট।
তাছাড়া কক্সবাজার কস্তূরী ঘাট থেকে স্পিড বোট বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে তারপর যেতে হবে মহেশখালী। মহেশখালী গোরকঘাটা থেকে বেবিট্যাক্সি/অটো রিক্সা করে যেতে হবে ঘটিভাঙা ঘাট। সেখান থেকে আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে হয়। মনে রাখতে হবে সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়া-আসা অনেকটা জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে। জোয়ারের সময় বোট ধরতে না পারলে পড়তে হবে দারুণ বিড়ম্বনায়। ভাটার সময় খালে খুব বেশি পানি থাকে না। তখন হাঁটু সমান কাদা দিয়ে হেঁটেই পার হতে হবে। উল্লেখ্য কক্সবাজার থেকেও সরাসরি স্পিডবোট রিজার্ভ করে সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেজন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হবে। যারা ভ্রমণকে অ্যাডভেঞ্চারময় করতে ভালোবাসেন তারা কিছু বাড়তি খরচ করে কক্সবাজার থেকে সরাসরি স্পিড বোটে করে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন?
সোনাদিয়ায় থাকার মতো কোনো পর্যটন হোটেল, মোটেল নেই। থাকতে হবে তাবুতে না হয় স্থানীয় লোকদের বাসায়। স্থানীয় লোকেরা তাবু ভাড়া দেওয়াসহ খাবার-দাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন, তাছাড়া রাতে তাবু পাহারার ব্যবস্থাও আছে। তবে আগে যোগাযোগ করে যেতে হবে। আমরা পৌঁছে উঠলাম ঘাটের পাশেই গিয়াস ভাইয়ের বাসায়। দুপুরের খাবার এবং রেষ্ট নিলাম সেখানে...। মূল্যবান জিনিষপত্র সেখানে জমা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারবেন দ্বীপ জুড়ে। তো শুরু করে দিন প্ল্যান। বা হুট করেই ঘুরে আসুন সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে।