তাজমহল-বিতর্ক : শিব মন্দির ‘তেজ মহালয়’ থেকে তাজমহল

জুন ৪, ২০১৭

প্রমীলা দাস লাবনী : সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ মহল-এর ডাকনাম আরজুমান্দ বেগম। নামের অর্থ ‘প্রাসাদের অলঙ্কার’। আরজুমান্দ বেগম ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন।আরজুমান্দের বাবা আবদুল হাসান আসাফ খান ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূর জাহানের ভাই। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে যুবরাজ খুররম (পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান) পছন্দ করে আরজুমান্দকে বিয়ে করেন। পরে তার নাম রাখা হয় মমতাজ মহল। আরজুমান্দ , সম্রাট শাহজাহানের কততম স্ত্রী তা নিয়ে মতভেদ আছে। উইকিপিডিয়ার মতে, আরজুমান্দ ছিলেন শাহজাহানের ২য় স্ত্রী। কারো মতে ৩য় আবার কারো মতে ৪র্থ স্ত্রী। যাই হোক, নিজেদের চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরে ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন আরজুমান্দ ওরফে মমতাজ মৃত্যুবরণ করেন।

শাহজাহানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও মমতাজের বিয়ে হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহান মমতাজের আগের স্বামীকে হত্যা করে মমতাজকে বিয়ে করেছিলেন। মমতাজকে বিয়ে করার আগে সম্রাট শাহজাহানের আরও তিন স্ত্রী ছিলেন। মমতাজকে বিয়ে করার পর সম্রাট শাহজাহান আরও তিনটি বিয়ে করেন। শুধু তাই নয়, মমতাজ মারা যাওয়ার পর শাহজাহান মমতাজের আপন ছোট বোনকে বিয়ে করেন। তাজমহলের ডিজাইনারের নাম ছিল ঈশা মোহাম্মদ। তিনি, তার স্ত্রীকে উপহার দেওয়ার জন্য একটি ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের পছন্দ হওয়ায় সেই ডিজাইনের আদলে বানানো হয় তাজমহল। সেই ব্যক্তির চোখ নষ্ট করে দেওয়া হয় যাতে তিনি নতুন করে আর এই ডিজাইন তৈরি করতে না পারেন। কথিত হয়, যে বিশ হাজার শ্রমিক দিনরাত খেটে এই মহলটি তৈরি করেছিলেন তাদের হাতও কেটে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। তাজমহলের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৬৩১ সালে, শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। এগুলো হচ্ছে আমাদের প্রায় সবার জানা কথা। অনেকে মনে করেন, এগুলো আসলে ইতিহাস নয়, গল্প।

প্রফেসর পিএন অক “তাজমহল: দ্য ট্রু স্টরি” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “তাজমহল মমতাজের সম্মানে নির্মিত প্রেমের সমাধিস্থল নয়, এটি প্রাচীন হিন্দু দেবতা শিবের মন্দির। এ মন্দিরের নাম ছিল ‘তেজ মহালয়’। ‘তেজ মহালয়’ থেকে তাজমহলের নামকরণ। এই মন্দিরে কেবল আগ্রার রাজপুতরা পূজা-অর্চনা করত। সাধারণ লোকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই সাধারণের কাছে এ মন্দির অত পরিচিত ছিল না। ইতিহাস অনুসন্ধান করে প্রফেসর পিএন অক আরও বলেন, সম্রাট শাহজাহান অন্যায়ভাবে জয়পুরের মহারাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে শিব মন্দিরটি দখল করে নিয়েছিলেন। পিএন অক যে দলিল উপস্থাপন করেন, সম্রাট শাহজাহান নিজেই তার দিনপঞ্জি ‘বাদশাহনামা’য় তা উল্লেখ করে গেছেন। সম্রাট লিখেছেন, রাজা জয় সিংহের কাছ থেকে আগ্রার এক চমৎকার প্রাসাদোপম ভবন মমতাজ মহলের সমাধিস্থলের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে এবং এর জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে রাজা জয় সিংহকে অন্যত্র জমিও কিনে দেয়া হয়েছে।

পিএন অক “তাজমহল: দ্য ট্রু স্টরিতে” শাহজাহান ও মমতাজের প্রেমকাহিনীর সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি উল্লেখ করেন, মমতাজ ও শাহজাহনের ভালোবাসার গল্প মূলত রূপকথা যা লোকমুখে সৃষ্ট। কারণ এত গভীর ও চমৎকার প্রেমের কথা ভারতের ওই সময়কার কোনও সরকারি নথিপত্রে বা গ্রন্থে উল্লেখ নেই। তিনি আরও কিছু ডকুমেন্টরি উপস্থাপন করেন যা প্রমাণ করে তাজমহল কখনোই সম্রাট শাহজাহানের আমলের নয়। নিউইয়র্কের আর্কিওলজিস্ট মারভিন মিলার যমুনা নদীর তীর সংলগ্ন তাজমহলের দেয়ালের নমুনা পরীক্ষা করেন। তিনি এর কার্বন টেস্ট করে তথ্য পান যে, এই কার্বন সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলেরও চেয়ে ৩০০ বছর বেশি পুরনো!

‘তাজমহলের’ নাম নিয়েও প্রফেসর অক সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মুঘলামলে এমনকি খোদ শাহজাহানের আমলেও কোনও দলিলাদি ও কোর্টের নথিপত্রে কোথাও ‘তাজমহলের’ নাম উল্লেখ নেই। আর সে সময়ে মুসলিম শাসনামলে কোনও ভবন বা প্রাসাদের নাম ‘মহল’ রাখার প্রচলন ছিল না। এছাড়া ‘তাজমহল’ নামটি এসেছে মমতাজ মহল থেকে এ বিষয়টিও প্রফেসর অক মেনে নেননি। তিনি এর পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করেন। প্রথম কারণ, সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রীর প্রকৃত নাম কখনোই মমতাজ ছিল না। দ্বিতীয় কারণ, সাইকোলজিক্যাললি কেউ কারও নামে প্রাসাদ নির্মাণ করলে নামের প্রথম দুই অক্ষর বাদ দিয়ে অর্থাৎ মমতাজের মম বাদ দিয়ে তাজ নাম রাখাটা মানব স্বভাবের মধ্যে পড়ে না।

প্রফেসর অক তাজমহলের স্থাপত্য শৈলীর কিছু অসামঞ্জস্যতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তাজমহল মূলত হিন্দু শিব মন্দির ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে, তাজমহলের কিছু কামরা শাহজাহানের আমল হতেই তালাবন্দি। যা এখনও জনসাধারণের অজানা রয়ে আছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন ওই সব কামরার একটাতে রয়েছে দেবতা শিবের মস্তকবিহীন মূর্তি অর্থাৎ শিব লিঙ্গ যা হিন্দুদের শিব মন্দিরে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়।

বিখ্যাত তাজমহল নিয়ে প্রফেসর অকের এ উল্টো বক্তব্য ও ইতিহাস তিনি যে গ্রন্থে লিখেছিলেন ভারতের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার ওটি বাজেয়াপ্ত করে দেয় এবং সবগুলো কপি বাজার হতে উঠিয়ে নেয়। ভারতে এর দ্বিতীয় কোনও কপি প্রকাশ করাও বন্ধ করে দেয়। সেখানে কারণ দেখানো হয়, যদি এ বই প্রকাশ করা হয় তাহলে ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের মাঝে ধর্মীয় এবং রাজনীতিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

পরবর্তীকালে প্রফেসর অকের প্রচলিত ইতিহাস বিরোধী বক্তব্য এবং তার গ্রন্থ
পর্যালোচনা করে গবেষকরা এ মত দিয়েছেন যে, তাজমহলের মার্বেল পাথর, ইসলামিক সংস্কৃতি, আল কোরআনের আয়াত ক্যালিওগ্রাফি এবং গম্বুজের কারুকাজ সম্রাট শাহজাহানের আমলে হয়ে থাকলেও তাজমহলের প্রাথমিক স্থাপনা শাহজাহান কর্তৃক না হয়েও থাকতে পারে।

তর্ক-বিতর্ক যতই থাকুক না কেন, তবু তাজমহল মুঘল যুগের মুসলিম স্থাপত্য কীর্তিসমূহের মধ্যে গৌরবান্বিত একটি অনন্য কীর্তি।

প্রমীলা দাস লাবনী এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।

 ঢাকা জার্নাল, জুন ০৪, ২০১৭।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.