উৎসবের কোনও লিঙ্গ হয় না!

এপ্রিল ১২, ২০১৬

Rasheda Rownakরাশেদা রওনক খান : বাঙালির একটিই প্রাণের উৎসব, বলা যায় ‘সবার উৎসব’, যে উৎসব জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই মহা-আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করেন, তা হলো বাংলা বর্ষবরণ! পৃথিবীতে প্রচলিত বেশিরভাগ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনও না কোনও ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কোনওভাবেই কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। তবু কিছু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই উৎসব নিয়ে চক্রান্ত করছে। আমাদের সমাজে এই মানুষগুলো সব ক্ষেত্রেই ধর্মকে টেনে এনে ‘শিরক ও বেদাতের’ সন্ধান করে নতুন-নতুন ফতোয়া তৈরি করেন।

অথচ এই উৎসব নিতান্তই ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি মানুষের প্রাণের উৎসব। প্রধানত, কৃষিকাজ এবং রাজস্ব সংগ্রহের প্রয়োজনেই এই বাংলা সনের সূচনা। পরবর্তী কালে যুক্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলার রীতি-নীতি। দিনে দিনে এই বর্ষবরণ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব।

সেই বিবেচনায় অসাম্প্রদায়িক বাঙালির একমাত্র বৈষম্যহীন উৎসব ছিল পহেলা বৈশাখ।  সকালের রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রা—এ যেন নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবার এক মিলন মেলা। সবাই উৎসবের প্রতিটি ক্ষণে উপস্থিত থাকতে পারেন, উপভোগ করতে পারেন, আয়োজনের মধ্যমনি হতে পারেন। এখানেই ছিল পহেলা বৈশাখের স্বাতন্ত্র্য, বাঙালি ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব।

যদিও গুটিকয়েক নির্লজ্জ, বেহায়াদের কাছে হার মানেনি কখনও এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবের উচ্ছ্বসিত আয়োজন, তবু মনে প্রশ্ন জাগে, হাজার বছরের এই ঐতিহ্য, উৎসব, আনন্দ আয়োজনকে এভাবে নষ্ট করার চক্রান্ত কাদের?

জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, ধর্মান্ধ কিছু পথভ্রষ্ট মানুষের কাজ, এটা স্পষ্ট। এই অপশক্তির আরও অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করার। সেই ২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালান এবং ঘটনাস্থলে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। নরহত্যাকে তারা তেমন কোনও গুরুতর পাপ বলে মনে করেন না! কপালে টিপ পরা থেকে শুরু করে পিচ-ঢালা পথে আলপনা আঁকা—সব কিছুই তাদের কাছে বিধর্মীয় আচার এবং তা দমন করতে তারা প্রতিবারই তৎপর হয়ে ওঠেন।

ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘৭১ পুর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির নববর্ষ-উদযাপনকে নানান কায়দায় নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিল, বাধাও দিয়েছিল বিভিন্নভাবে। আজ আমাদের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধুর কন্যা যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে, তখনও একটি গোষ্ঠী একই কায়দায় নববর্ষ-উদযাপনকে বন্ধ করতে চাচ্ছে, কিন্তু কার ছত্রচ্ছায়ায়, তা খুব জানতে ইচ্ছে করে!

তাই নববর্ষের প্রাক্-কালে আনন্দে-শিহরিত মনে শঙ্কা জাগে,আমরা কি আগের মতো করে বলার সৎসাহস রাখি? এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার আনন্দ আয়োজন? আজ মনে প্রশ্ন জাগে, নারীরা কি আগের মতো করেই শঙ্কাহীনভাবে উৎসবে যেতে পারবে?

ধর্মীয় উৎসবগুলোয় লিঙ্গের বৈষম্যের জায়গা খুব পরিষ্কারভাবে টানা, এই বৈষম্য যতটা না ধর্মের, তার চেয়ে বেশি সমাজের। যেমন অনেক দেশেই এমন খোদ আমেরিকাতেও হাজারে হাজারে নারীকে দেখতাম ঈদের দিন মসজিদ এ যাচ্ছেন নামাজ আদায় করতে, কিন্তু ধর্মপাগল বাংলাদেশে তা কি সম্ভব? মসজিদ তো তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর। কয়টা মসজিদ আছে নারীর জন্য? পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশে নারীরা প্রবেশ করতে পারে এমন মসজিদের সংখ্যা হাতে গোনা। তারপর স্বামী মসজিদ থেকে ফিরলেই দিতে হবে সেমাই-কোরমা-পোলাও। সেগুলো তৈরি করবে কে? তাই রান্না চলে ভোরবেলা থেকেই। ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে এভাবেই নারীকে মুক্তি দেয় না  সমাজ। ‘ঘরের নারী’র বাইরের উৎসবে অর্থাৎ মসজিদ এ যাওয়ার সময় মেলে না।

ঢাকা জার্নাল, এপ্রিল ১২, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.