এক রজনীতে বহু রমনীকে খুশি করার দাওয়া্ই!
এপ্রিল ২, ২০১৩ ঢাকা জার্নাল: বিজ্ঞাপন চিত্র কোনো একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আয়ের একটি অন্যতম উৎস। আর তাই একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচারের বেশিভাগ সময় বিজ্ঞাপন চিত্র প্রচার করা হবে এটায় স্বাভাবিক। তবে বিজ্ঞাপন চিত্র ক্ষেত্রে অবশ্যই নীতি-নৈতিকতা মেনেই নির্মাণ করা উচিত বা করা হয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে আমাদের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে বেশ কয়েকটি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন চিত্রে চিত্রায়ণ, সংলাপ এবং বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এখানে কোনো নীতি-নৈতিকতা মানা হয়েছে কী না?
এক বাক্যে এসব বিজ্ঞাপন চিত্র হচ্ছে যৌনতা নির্ভর। অরক্ষিত যৌন সঙ্গম, বহু নারী সহবাস এবং বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কে উৎসাহ দেয়া এসব বিজ্ঞাপন চিত্র বিনা বাধায় প্রচারিত হচ্ছে আমাদের দেশে।
এক দিকে সমগ্র বিশ্বে যখন এইডসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, অন্য দিকে ভারতীয় চ্যানেলের এসব বিজ্ঞাপন চিত্র এইডস বিরোধী প্রচেষ্টাকে রুখে দিচ্ছে।
করপোরেটের এই যুগে ভারতের একচেটিয়া বাণিজ্যিক মনোভাবের কাছে এইচআইভি (এইডস) বিরোধী আন্দোলন আজ হুমকির মুখে। বিশেষ করে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সামাজিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন কিংবা এইডসের মতো ভয়াবহ বিষয়টিকে অমলে নিচ্ছে না তারা।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও জন্ম নিরোধক পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো রাত ১২টার পর এবং এসব বিজ্ঞাপন নির্মাণের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ সেন্সর মেনে চলা হতো।
কিন্তু ইদানিং জন্ম নিরোধক পণ্য, বডিস্প্রে (সুগন্ধি) এবং বিশেষ করে যৌন শক্তি বর্ধক হারবাল ওষুধের বিজ্ঞাপন যে ভাবে চিত্রায়ন করা হচ্ছে তাকে সচেতন মহলের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, করপোরেটের বরাতে সামাজিকতার কি মৃত্যু হয়েছে?
কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে। সম্প্রতি ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে জন্ম নিরোধক পণ্যের (কনডম) বিজ্ঞাপন আর স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। একটি বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে ‘শ্রেষ্ঠ বীর পুরুষ’ নির্বাচনের একটি রিয়েলিটি শো’তে গ্রান্ড ফাইনালে তিন জন যুবক প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে। তাদের প্রত্যেকের ফাইল রাউন্ডে ইভেন্ট হলো ততোধিক যুবতীকে সন্তুষ্ট করা। আর এই রাউন্ড দুই জন অংশ গ্রহণ না করে পরাজয় মেনে নিলেন, কিন্তু একজন পিছ পা হলেন না। কারণ তার কাছে আছে নির্দিষ্ট ব্রান্ডের জন্ম নিরোধক ( কনডম)।
এতো গেল কনডমের বিজ্ঞাপনের ধরণ। বডিস্প্রের (সুগন্ধি) বিজ্ঞাপনের চিত্রায়নটা আরো ভয়াবহ। নতুন কনে বাসর করে বসে রয়েছেন স্বামীর অপেক্ষায়। হঠাৎ পাশের ফ্লাটের এক যুবক ব্যবহার করছে নির্দিষ্ট একটি ব্রান্ডের বডি স্প্রে, আর সেই বডিস্প্রের গন্ধে সদ্য বিবাহিত কনে ঘরের জানালা খুলে অপরিচিত যুবকের সামনে প্রস্তুতি নিতে থাকেন বিবস্ত্র হওয়ার। এমনটিও হয় বিজ্ঞাপনে!!
কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে যৌন শক্তি বর্ধক দাওয়ায় বা হারবাল ওষুধের বিজ্ঞাপন। আর দীর্ঘ সময়ের এসব বিজ্ঞাপনে অংশ নিচ্ছে স্বল্প বস্ত্রের ভারতীয় চলচিত্রের আইটেম গার্ল খ্যাত নায়িকারা।
রাত ১২টার পর ভারতীয় ৯এক্সএন, রূপসী, জি টিভিসহ বেশ কয়েকটি চ্যানেলই দখল করে রেখেছে ডাক্তার আয়ুরবেদার ‘শক্তি প্রাস’ যৌন শক্তি বর্ধক দাওয়ায়ের বিজ্ঞাপন। আর এই বিজ্ঞাপনগুলো দেখে অবাক হতে হয় এটা ভেবে, যে আসলেই তারা কোন ওষুধের বিজ্ঞাপন করছে নাকি বহু নারী সঙ্গমের প্রতি উৎসাহ দিচ্ছে।
একটি বিজ্ঞাপনের চিত্রায়ন এমন, একজন ‘সুপুরুষ’ যুবক সকাল বেলা তার সঙ্গীনির কাছ থেকে উঠলেন। কিন্তু তার শরীরে বস্ত্রগুলো ছড়িয়ে, ছিটিয়ে রয়েছে আরো পাঁচজন রমনীর কক্ষে। অবশেষে তিনি যখন বের হলেন, তখন বোঝানো হলো তিনি ছিলেন একটি আবাসিক হোটেলে। আর তারা সবাই ছিল পতিতা। সর্বশেষ এই ‘বীরকে’ জিজ্ঞাসা করা হয় তার শক্তির রহস্য কি? তখন তিনি দেখিয়ে দেন ‘শক্তি প্রাস’। শক্তি প্রাসের এসব বিজ্ঞাপনের চিত্রায়নের ক্ষেত্রেও শালীনতা বজায় রাখা হয়নি। যে কেউ এই সব বিজ্ঞাপন দেখলে বিব্রত হতে পারেন।
তবে এসব বিজ্ঞাপন অসামাজিক কার্যক্রমে ও অরক্ষিত যৌন মিলনে যুব সমাজকে উৎসাহিত করছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে চিকিৎসকরা বলছেন এসব যৌন শক্তি বর্ধক ওষুধ মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান যতটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর কৃত্রিমভাবে যৌন শক্তি বৃদ্ধি করলেও শরীরের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী শরীরিক ক্ষতি হতে পারে।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনগুলো বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত থাকায় তার প্রভাবও আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা।
এব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আমান উল্লাহ ফেরদৌস মনে করেন, “ ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে যে ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে তা বিজ্ঞান সম্মত নয়। কারণ যৌন শক্তি বর্ধক ওষুধের কোনো বিজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
দ্বিতীয়ত এধরনের বিজ্ঞাপন নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের চিত্রায়ন করা হচ্ছে তা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্বের সামাজিকতার জন্য গ্রহনযোগ্য নয়।”
তিনি বলেন, “ এধরনে বিজ্ঞাপন প্রচারের ফলে ইতোমধ্যে আমাদের নতুন প্রজন্মের উপর এক প্রভাব ফেলেছে। গবেষনা দেখা গেছে শুধুমাত্র স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা বছরে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার পর্ণগ্রাফি ডাউনলোড করছে। আরেক গবেষণা দেখা যায়, বাংলাদেশে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে বিবাহপূর্বক যৌন সম্পর্ক ও প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে বিবাহ বর্হিভূত যৌন সম্পর্কের হার বিগত দুই বছরের মধ্যে তিনগুন বেড়ে গেছে।”
আমান উল্লাহ বলেন, “ তবে অবাক হয় এটা দেখে যে, কিভাবে এধরনের বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে প্রচারিত হয়। ভারতের অনেক রাজ্যে এধরনের বিজ্ঞান চিত্র প্রচার নিষিদ্ধ রয়েছে।”
তিনি বলেন, “ আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত কেবল অপারেটদের সঙ্গে বসে এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা, যাতে করে রাত ১১টা পর থেকে এধরনের চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়।”
এব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান পারভিন হক বলেন, “ একেক ভৌগোলিক পরিবেশের সামাজিক আচার-আচারন একেক রকম। পশ্চিম বঙ্গের রীতিনীতি, সামাজিক প্রথার সঙ্গে আমাদের অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু পুরো ভারত চলছে একটি নির্দিষ্ট সামাজিক প্রথার মধ্যে। ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে যে ধরণে বিজ্ঞাপন চিত্র দেখানো হচ্ছে তা শুধু মাত্র আমাদের দেশের জন্য না পশ্চিম বঙ্গে জন্য কুপ্রভাব ফেলছে।”
তিনি বলেন, “ গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ শিক্ষিত হয়, সচেতন হয় কিংবা কিছু একটা শেখে। আমাদের জীবনধারা, পরিবার প্রথা এবং লাইফ-স্টাইলের সঙ্গে পশ্চিমাদের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশে পরিবার কেন্দ্রিয় সম্পর্কগুলোকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক আমাদের সামাজিক ইতিহাস, ঐতিহ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই যেসব গণমাধ্যমে এধরণে ভিন্ন সামাজিক প্রথার আচার-আচারণ প্রচার করা হচ্ছে সেগুলো আমাদের দেশে বন্ধ রাখাটায় ভালো। আর এধরণের বিজ্ঞাপন চিত্র দেশের তরুন ও যুব সমাজের উপর একটি মনস্তাত্তিক প্রভাব ফেলবে।”
পারভিন হক বলেন, “ যেখানে সমস্ত বিশ্ব এইচআইভি’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সেখানে যৌনচারকে উৎসাহিত করে কোনো বিজ্ঞাপন চিত্র প্রকাশ করা অর্থ হলো এইডস’কে উৎসাহিত কর।”
লেখক- পঞ্জেরী
ঢাকা জার্নাল, এপ্রিল ২, ২০১৩