স্বৈরশাসকের পতন এবং হাতছাড়া বিজয়- সেলিম

ডিসেম্বর ৫, ২০১৫

16এরশাদ শাহি’র পতনের ২৫ বছর পার হতে চলেছে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাস শুরু হওয়ার আগেই, আট বছর ধরে চলতে থাকা স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছিল। শেষ দমনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বৈরশাসক রাজধানীতে কারফিউ জারি করেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলো তা অমান্য করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছিল। ‘১৫, ৭ ও ৫ দলের যৌথ আহ্বান ও নির্দেশাবলি’ শিরোনামে যে নির্দেশ তিন জোট ১ ডিসেম্বর ১২টি পদক্ষেপ ও কর্মসূচির ঘোষণা করেছিল তার প্রথমটিতে বলা হয়েছিল ‘গণবিরোধী খুনি এরশাদ সরকারের তথাকথিত জরুরি আইন, কারফিউ, ১৪৪ ধারা প্রভৃতি উপেক্ষা করে দেশের সর্বত্র শহরে-বন্দরে, হাটে-বাজারে, পাড়ায়-মহল্লায়, রাজপথে লাখো মানুষের সমাবেশ ও মিছিল অব্যাহত রাখুন। প্রতিদিন সর্বত্র জঙ্গি মিছিল সংঘটিত করুন এবং গণ-আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করুন।’
দেশের সর্বত্র, বিশেষত ঢাকায় জনগণ সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। কারফিউ অগ্রাহ্য করেছিল। তিন জোটের ৫ নম্বর নির্দেশটি মেনে ২ ডিসেম্বর জোহরের নামাজের পর ১ ডিসেম্বরের শহীদানদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় ‘গায়েবানা জানাজা’ শেষে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে মিছিল করেছিল। ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় কেন্দ্রীয় সমাবেশ করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিল যে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুসারে এরশাদের পদত্যাগ ব্যতীত কম কিছু গ্রহণযোগ্য হবে না। গণ-আন্দোলন ক্রমেই গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নিতে শুরু করেছিল। এ অবস্থায় সামরিক, বেসামরিক প্রশাসন এরশাদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে শুরু করেছিল। সব দিক থেকে পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকায় ৪ ডিসেম্বর এরশাদ ‘তিন জোটের রূপরেখায়’ বর্ণিত পথে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেদিন রাতের সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ সর্বত্র বিজয়-আনন্দে লাখো মানুষ রাজপথে নেমে পড়েছিল।
বাঙালি হলো বীরের জাতি। সে লড়াই করে বিজয় অর্জন করতে পারে। কিন্তু এ কথাও সত্য যে বিজয় অর্জন করতে জানলেও সে সব সময় সেই বিজয়কে ধরে রাখতে পারে না। ২৫ বছর পরে হিসাব কষে এ কথা বলতে বাধ্য হতে হয় যে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত সেদিনের গণ-আন্দোলনের বিজয়ও পূর্ণাঙ্গভাবে ধরে রাখা যায়নি। অন্য নানা বিষয়ের সঙ্গে খোদ এরশাদ স্বয়ং ও তাঁর দলের চার নেতা যে সরকারের ‘বিশেষ দূত’ ও মন্ত্রিসভার সদস্য ও উপদেষ্টা, তা এ সত্যেরই এক ট্র্যাজিক নিদর্শন। এ ঘটনা এ কথাও প্রমাণ করে যে দেশে বর্তমানে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করা বুর্জোয়া ধারার রাজনীতিতে গণ-আন্দোলনের বিজয়ের প্রতি সম্মান ও নীতি-আদর্শবোধ এখন স্রেফ উপযোগিতার (কনভেনিয়েন্স) বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

দুই
এরশাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণ-আন্দোলন শুধু ‘ব্যক্তি এরশাদের’ বিরুদ্ধে ছিল না। তা ছিল দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অভিশাপ থেকে দেশকে চিরদিনের জন্য মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত। এরশাদ-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামকালে রাজনৈতিক জোট ও দলগুলোর নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও তাঁদের বিভিন্ন ইশতেহার ঘোষণা সে কথাই প্রমাণ করে।
ক্ষমতা দখলের এক বছরের মাথায় এরশাদ ঘোষণা করেছিলেন যে এখন থেকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারিতে’ শহীদ মিনার অভিমুখে প্রভাতফেরি করা ও সেখানে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি বেদাত কাজ। এখন থেকে এই দিনে শহীদ মিনারে শুধু কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির আয়োজন করা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা তর্কবাগীশের বাসায় একত্র হয়ে রাজনৈতিক নেতারা একটি যৌথ প্রতিবাদ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। সে থেকেই সূচিত হয়েছিল ১৫-দলীয় জোট। এর আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল সংগ্রাম। সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে চলছিল শ্রমিকদের সংগ্রাম। খেতমজুরেরাও স্থানীয়ভাবে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন। এরশাদ স্বৈরাচারের গুলিতে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কনু মিয়া। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে নেমেছিল ছাত্রসমাজ। গুলি চলেছিল। শহীদ হয়েছিলেন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি, আইউব, ফারুক, মোজাম্মেল প্রমুখ। অল্প দিন পরেই ১৫ দলের পাশাপাশি গঠিত হয়েছিল ৭-দলীয় জোট। দুই জোট আলোচনা করে ঘোষণা করেছিল ৫ দফা দাবি। সেই ভিত্তিতে উভয় জোটের যুগপৎ ডাকে পালিত হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথম হরতাল। শুরু হয়েছিল সংগ্রামের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। একপর্যায়ে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না-করা প্রশ্নে ১৫ দল থেকে কয়েকটি দল বেরিয়ে গিয়ে ৫-দলীয় জোট গঠন করেছিল। এই বিভক্তি আন্দোলনের সমূহ ক্ষতি সাধন করলেও কিছুদিন পর আবার ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবার শুরু হয়েছিল দুই জোটের বদলে তিন জোটের যুগপৎ আন্দোলনের ধারা। ঐক্যকে আরও দৃঢ় করার জন্য একপর্যায়ে তিন জোটের আনুষ্ঠানিক ‘লিয়াজোঁ কমিটি’ গঠনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
এরশাদ-স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রাজনৈতিক জোটগুলোর পাশাপাশি শুরু হয়েছিল শ্রমিক, কৃষক-খেতমজুর, ছাত্র, পেশাজীবীদের নিজ নিজ দাবিতে পরিচালিত সংগ্রামের ধারা। ১৫, ৭ ও ৫-দলীয় জোটের যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটি দেশবাসীকে পুনরায় আশ্বস্ত করে বলতে চায় যে এরশাদ ও সামরিক জান্তা গত ছয় বছরের শাসনে (তখনকার হিসাব) দেশি-বিদেশি লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থে জাতীয় ও গণস্বার্থবিরোধী যে নীতি অনুসরণ করেছে, তাকে সমূলে উৎপাটিত করে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করবে। আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারীদের ৫ দফা, কৃষক-খেতমজুরদের ১০ দফা, ছাত্রদের ১০ দফাসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের দাবি পূরণ করবে।’
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটি গঠিত হওয়ায় গণসংগ্রামের ধারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। এরশাদ তখন বলতে শুরু করেছিলেন যে তাঁর ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার কোনো সংবিধানসম্মত পথ নেই। তাই তিন জোটের দাবি মানতে হলে সংবিধান লঙ্ঘন করতে হয়। অতএব পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত তাঁকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। কিন্তু তিন জোট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যে ‘এরশাদকে ক্ষমতায় রেখে কোনো নির্বাচনই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও তারা বলেছিল যে ‘সংবিধানবহির্ভূত অন্য কোনো পন্থায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গোষ্ঠীবিশেষের ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা জনগণ প্রতিরোধ করবে।’ এ অবস্থায় তিন জোটের সামনে এরশাদের ক্ষমতাত্যাগের একটি সাংবিধানিক পন্থা বাতলে দেওয়ার রাজনৈতিক কর্তব্য হাজির হয়েছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটি তখন কাজ শুরু করেছিল।
এ কাজটির হোমওয়ার্ক অবশ্য আমরা আগেই শুরু করেছিলাম। আমি নিজে এ ধরনের রূপরেখার একটি প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করেছিলাম। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার কাছে আমি নিজে গিয়ে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমার প্রথম খসড়ায় নির্বাচনব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আগামী তিনটি নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু উভয় নেত্রী রূপরেখা থেকে এ বিষয়টি বাদ রাখার জন্য বলেছিলেন। রূপরেখার খসড়া প্রস্তুত করার জন্য ১৫ দল একটি কমিটি বানিয়ে দিয়েছিল। আমিও সে কমিটিতে ছিলাম। আমাকে প্রাথমিকভাবে খসড়াটি লিখতে বলা হয়েছিল। সেটি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছিল। অতঃপর তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটিতেও প্রস্তুতকৃত খসড়ার ভিত্তিতে আলোচনা শুরু হয়েছিল। ১৯৯০ সালের ২১ অক্টোবর সিপিবি অফিসে অনুষ্ঠিত তিন জোটের পূর্ণাঙ্গ বৈঠক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছিল। ঐকমত্যের ভিত্তিতে এরশাদের ক্ষমতা ছাড়ার সাংবিধানিক রূপরেখা ঘোষিত হওয়ায় সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় সূচনা করার পটভূমি তৈরি হয়েছিল।
তিন জোটের ঐতিহাসিক রূপরেখায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক পথ বাতলে দেওয়ার পাশাপাশি তাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কিছু আমি উদ্ধৃত করছি। রূপরেখায় ছিল, ‘দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের’ কথা, ছিল ‘হত্যা, ক্যু প্রভৃতি অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা বদলের অবসানের’ কথা, ছিল ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করার’ কথা, ছিল ‘ভোটারগণের নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তার’ কথা, ছিল ‘গণমাধ্যমের পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতার’ কথা, ছিল ‘নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদ’ এবং সেই সংসদের কাছে সরকার জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকার’ কথা, ছিল ‘জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার’ কথা, ছিল ‘মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিল করার’ কথা।
এসব কথার বাইরে ১৫ দলের পক্ষ থেকে ‘এরশাদ সরকারের অবসানের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তি শাসকেরই পরিবর্তন নয়, একই সঙ্গে বর্তমানে প্রচলিত প্রতিক্রিয়াশীল আর্থসামাজিক ধারা ও ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে বিকল্প গণতান্ত্রিক ধারা ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার’ প্রতিশ্রুতিও ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৫ দল একবার ২১ দফা ও আরেকবার ৭ দফা রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিল।
এরশাদ-স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। তারপরে ২৫ বছর পার হয়েছে। কিন্তু কুৎসিত ও বিপজ্জনক ‘ক্ষমতার খেলা’ প্রচুর হলেও সব বুর্জোয়া সরকারই এসব ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। এর প্রধান কারণ হলো, কোনো সরকারই এরশাদের অনুসরণ করা আর্থসামাজিক ব্যবস্থার আমূল রূপান্তর না করে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদের লুটপাটের সেই ধারা ও ব্যবস্থাই অব্যাহত রেখেছে। এই আর্থসামাজিক ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল হলো গণতন্ত্রহীনতা ও কোনো না কোনো পন্থার স্বৈরতান্ত্রিকতা। স্বৈরাচারের আর্থসামাজিক জমিনের ওপরে গণতন্ত্রের ফুল ফোটার কাজটি যে সম্ভব হওয়ার নয়, এ কথা যে কত সত্য তা জাতি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
selimcpb@yahoo.com

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.