12‘একলা চলো রে’ নীতির গোঁ পরিত্যাগ করে রাহুল গাঁধী এবার নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদের জোটসঙ্গী হয়েছিলেন। বিগত লোকসভা নির্বাচনেও জঙ্গলরাজের ‘খলনায়ক’ লালুর সঙ্গে তিনি হাত মেলাতে রাজি ছিলেন না। যুক্তি ছিল, কংগ্রেসের নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি শ্রীবৃদ্ধি। এবার সব ভুলে অঙ্কের নিয়মে বিজেপিকে পরাস্ত করতে অনেক বেশি মরিয়া ছিলেন রাহুল। কিন্তু রাহুল দলের পথ বদলালেও ‘একলা চলো রে’ নীতি ছাড়তে কিন্তু এখনও রাজি নন সিপিএমের দলের তাত্ত্বিক নেতা প্রকাশ কারাট।

এবার বিহারে লালু-নীতীশের সঙ্গে হাত মেলাতে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে। কংগ্রেস চেয়েছিল, বিজেপির বিরুদ্ধে গঠিত হোক মহাজোট। সিপিএম  দলে কংগ্রেসের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। অঙ্কের মতাভেদে বা নির্বাচনী পাটিগণিতের কথা ভেবে রাজি ছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। কিন্তু প্রকাশ কারাট এ বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানান। পলিটব্যুরোর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য প্রকাশকেই সমর্থন করেন। এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে সীতারাম দলের সাধারণ সম্পাদক হলেও সংখ্যার বিচারে পলিটব্যুরোর মধ্যে এখনও কারাটের নিয়ন্ত্রণই অনেক বেশি। ফলে সীতারাম কংগ্রেসের হাইকমান্ডকে জানিয়ে দেন, বিহারে এই জোটে তাঁরা সামিল হচ্ছেন না। দলের যুক্তি ছিল, লালুর জঙ্গল রাজ-এর বিরুদ্ধেও জনমত বিহারে তীব্র। ফলে সেই অসন্তোষের পরিসরটা সম্পূর্ণ বিজেপির হাতে তুলে না দিয়ে কমিউনিস্টদের একটা পৃথক পরিসর রাখা ভাল। তখন এই ঘটনায় নীতীশ এবং লালু কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হন। কিন্তু এখন সিপিএম দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, এই ‘একলা চলো রে’ নীতি কি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন এবং পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনেও একইরকম ভাবে রক্ষা করতে হবে? না কি লালু-নীতীশের মতো স্ববিরোধী দুই শক্তি যদি এক হয়ে অঙ্কের বিচারে পরাস্ত করতে পারে বিজেপিকে, তা হলে সেই একই অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাবে না কেন? কেনই বা পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বিরোধী একটা সার্বিক ফ্রন্ট গঠন করবে না?

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস হাইকমান্ড এবং রাজ্য নেতৃত্ব শিলিগুড়ি মডেলের পক্ষে। অধীর চৌধুরী শুধু নন, বিহারের পর রাহুল গাঁধীও এ বিষয়ে বিকল্প খোলা রাখছেন। কিন্তু প্রকাশ কারাট এবং তাঁর অনুগামীরা মনে করছেন, কংগ্রেসের নীতি বিজেপির মতোই একইভাবে পরিত্যাজ্য। এখানে মমতাকে হারানো বা বিজেপিকে নির্বাচনে হারানোর থেকেও দলের মতাদর্শগত অবস্থানকে লঘু না করা কারাটের একটা বড় লক্ষ্য। ফলে শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্য যেটা করতে পেরেছেন, সেটা পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য স্তরে করাটা যে সহজ হবে না, তা কংগ্রেস নেতারাও বুঝতে পারছেন। তাছাড়া সীতারাম ইয়েচুরি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে প্রস্তুত এমন একটা ধারণা প্রবল বলে সীতারাম নিজেও এ বিষয়ে একটু রক্ষণাত্মক। এবারে পলিটব্যুরো বৈঠকে তাই ঠিক হয়েছে, আগে সংগঠনকে মজবুত করা হোক। তারপর অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলের মধ্যে জোটের কথা ভাবা হোক। তারপর সবশেষে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার কথা ভাবা হবে। সেটা পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের সময় নয়।

সিপিএমের এক প্রবীণ নেতার তির্যক মন্তব্য, ‘‘আমাদের দলের সামনে অমিত শাহ বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবথেকে বড় রাজনৈতিক শত্রু নয়। সবথেকে বড় শত্রু হলেন বারাক ওবামা। কাজেই মতাদর্শগত বিচ্যুতি আমরা বরদ্স্ত করতে পারব না। সিপিএমের দলের মধ্যে থেকে অবশ্য প্রশ্ন উঠছে, বিহারে সিপিএম লালুর সঙ্গে জোট বেঁধে অতীতে তাঁদের শতকরা ভোট অনেক বেশি ছিল। লালুর সঙ্গে জোট ছিন্ন করার ফলশ্রুতি হিসেবে গত ৩০ বছরে বিহারে বামেদের ভোটের হার ১০ শতাংশ থেকে কমতে কমতে এখন ২.৫ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এবারের ভোটে বামেরা মোট ৩.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। যার মধ্যে সিপিএম পেয়েছে মাত্র ০.৬ শতাংশ ভোট। ২০০০-এও বামেরা বিহার বিধানসভায় ১৪টি আসন পেয়েছিল। ২০০৫-এও পেয়েছে ৯টি আসন। গত বিধানসভায় সিপিআই একটি আসন পেয়েছিল। এবার সিপিআই (এম-এল) তিনটি আসন পেলেও সিপিএম বা সিপিআই একটিও আসন পায়নি।

এখানে প্রশ্ন উঠেছে, হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ এই সহজ সরল সত্যটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই মতাদর্শগত জোটের পাশাপাশি কৌশলগত জোটের দিকে নজর দিতেন। জোট রাজনীতির তিনি একজন চাণক্য ছিলেন। কখনও লালু কখনও মুলায়মের সঙ্গে থেকে নিজের আসন ও শতরা ভোট বাড়িয়েছেন। এখন রাহুল ‘একলা চলো রে’ নীতি বিসর্জন দিয়ে কৌশলের রাজনীতিতে পৌঁছেছেন। কিন্তু প্রকাশ কারাট এখনও রাজি নন।