মোহাম্মদ ফরহাদ: বিনম্র শ্রদ্ধা

অক্টোবর ৯, ২০১৫

05বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তের একটি জেলা শহর দিনাজপুর। ব্রিটিশ শাসনামলেরও আগে থেকে জেলা শহর হিসেবে পরিগণিত হতো। এই জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমা পঞ্চগড়, যা পরে জেলায় উন্নীত হয়েছে। বর্তমান পঞ্চগড় জেলার অধীনে বোদা থানা। সেই থানার একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি আহমেদ সাদাকাতুল বারী। যে যুগে তিনি বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন, তখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন ছিল অত্যন্ত সীমিত। তাই আশপাশের গ্রাম থেকে তাঁকে লোকজন দেখতে যেত। তিনি শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়ার পর বিটি ডিগ্রি অর্জন করেন। এ রকম শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সন্তান ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দিনাজপুর। ধারণ করেছে বাংলার বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের রক্তস্নাত ইতিহাস। জেলার আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য, বাবার শিক্ষানুরাগের স্পৃহা সঞ্চারিত ছিল মোহাম্মদ ফরহাদের মননে। তাঁর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘অবশ্য রাজনীতি সম্পর্কে আমার অন্তরে ভাবনার উন্মেষ হয়েছিল অনেক আগে।…লেনিনের বই পড়েছিলাম কী করিতে হইবে। নবম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় অবশ্য কী বুঝেছিলাম সেই বই পড়ে, আজ তা আর মনে নেই। আরও বই পাঠ করেছিলাম। মোদ্দাকথায় অবশ্য একটা কথা বুঝেছি যে ধনী আর দরিদ্র, শোষক আর শোষিত—এই হলো মূল দ্বন্দ্ব। আর শোষণমুক্ত সমাজের নাম হলো সমাজতন্ত্র।’ স্কুলের ছাত্রাবস্থায় গৃহীত এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যই আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। একজন সাধারণ কমিউনিস্ট কর্মী থেকে হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় পর্যায়ের একজন রাজনৈতিক নেতা। তাঁর অগ্রসর চিন্তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিশ্লেষণের ক্ষমতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার সঙ্গে সে সময়ের সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মী পরিচিত।
কমরেড ফরহাদ, আমার মতো অসংখ্য কর্মীর ‘ফরহাদ ভাই’ প্রসঙ্গে যে কথাটি এখানে বলতে চাই, সেটি হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর মমত্ব ও দায়িত্ববোধ। শ্রমিক-কৃষকের জীবনের প্রান্তিকতা ও তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রাম সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ অবহিত। কিন্তু নারীর জীবনের প্রান্তিকতা ও তাঁর মুক্তি-আন্দোলন বিষয়ে খুব আগ্রহ সব জাতীয় নেতার মধ্যে আছে বলে এখন জানা নেই। কিন্তু প্রান্তিক নারীগোষ্ঠীর জীবন নিয়ে কমরেড ফরহাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, তিনি এ ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে ভাবতেন।
মোহাম্মদ ফরহাদ স্মারকগ্রন্থ আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা হাতে নিয়ে দেখলাম, তাতে ৫৮ জন ব্যক্তির লেখা গ্রন্থিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন নারী। এই নারীদের তালিকায় আছেন আমাদের মধ্যে দু-একজন তাঁর হাতে গড়া কর্মী। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত নন অথচ কোনো না কোনোভাবে মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অথবা স্বল্প পরিচিত নারীও আছেন এই স্মরণিকার লেখকের তালিকায়। তাঁর পরিবারের যাঁরা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁরা জানিয়েছেন যে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনকে মোহাম্মদ ফরহাদ প্রভাবিত করেছেন, উন্নত করতে সহায়তা করেছেন।
এরপর আসতে চাই আমাদের কাজ, অর্থাৎ নারী আন্দোলনের অভিজ্ঞতায়। উল্লিখিত স্মরণিকায় মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদিকা মালেকা বেগম লিখেছেন, ‘আমাকে তিনি বলেছিলেন বহুবার বহুভাবে। এ দেশের নারী আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন সুপরিকল্পিতভাবে সকল স্তরের, সকল মতের মহিলাদের সমস্যা সমাধানের জন্য দল–মতের ঊর্ধ্বে থেকে।’ আজকে আমরা বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখব, রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে নারী আন্দোলন একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে শক্তি অর্জন করেছে।
আমরা গুটি কয়েকজন পার্টি কর্মী ছাত্রজীবন শেষ করে নারী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম মোহাম্মদ ফরহাদের নির্দেশে। আমাদের তিনি পরিচালনা করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে সর্বস্তরের নারীর জন্য আন্দোলনমুখী বহুমাত্রিক গণ–নারী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে অসংখ্য অরাজনৈতিক নারীর প্রচেষ্টায়, পরিশ্রমে, সম্পৃক্ততায়।
আজকের নারী সমাজের সমস্যাগুলোর অন্যতম হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর ভয়াবহ সহিংসতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সংকটময় জাতীয় পরিস্থিতিতেও নারীর অবমাননায় মোহাম্মদ ফরহাদ ক্লিষ্ট হতেন। এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে বলতেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা শহরে তিন বছরের মেয়ে সোনিয়া ধর্ষণের ঘটনায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল প্রতিবাদ আন্দোলনের ঘোষণা দেন এবং আহ্বান জানান, ‘জাতির বিবেক জাগ্রত হও’। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ দেশের যুবসমাজসহ অনেকেই নারী আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায়। এলাকায় এলাকায়, পাড়া-মহল্লায় গঠিত হয় ‘সামাজিক অনাচার ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি’। এই কমিটিগুলো সংগঠিত করার কাজে সেই কমিউনিস্ট পার্টির থানা শাখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের নির্দেশে। এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, সমাজকর্মীসহ সবাই যুক্ত হন এই কমিটিতে। নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনে সমাজকে যুক্ত করার যে পথ রচনায় মোহাম্মদ ফরহাদ শামিল হয়েছিলেন, আজও তা প্রায়োগিকতার দাবি রাখে।
১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রণী নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ও পরিবারের শূন্যতা অপূরণীয়। কিন্তু বাংলাদেশ নারী আন্দোলনও হারিয়েছে এক সুহৃদ, অভিভাবক ও সহযাত্রীকে। তারপরও বিশ্বাস করতে চাই, তিনি আছেন আমাদের সাথি হয়ে চিন্তায়, কর্মে ও আন্দোলনে।
যে কথাটি না বলে এই লেখা শেষ করতে পারছি না, সেটা হলো কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ আমাদের ব্যক্তিগত জীবন গড়ে তুলতে যে সহায়তা করেছেন, সামাজিক দায়িত্ব পালনের যে সূত্র শিখিয়েছেন, তার কারণে সারা জীবনেও তাঁর ঋণ পরিশোধ হবে না। ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
ফওজিয়া মোসলেম: বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভানেত্রী, চিকিৎসক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.