গ্রেনেড হামলার বিচার নিয়ে স্বজনদের সংশয়

আগস্ট ২১, ২০১৫

21সঞ্জীব দাস : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে একে একে ১০ বছর। গত এগার বছরেও এই নারকীয় হামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি । কাল বৃহস্পতিবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দশম বর্ষপূর্তি। মামলার বিশাল সাক্ষী বহর আর আসামির সংখ্যাধিক্যের কারণে বর্তমান সরকারের গত মেয়াদেও শেষ হয়নি নৃশংসতম এ হত্যাকান্ডের বিচার। কবে হবে এই হত্যাণ্ডের বিচার, এনিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান জানান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তৎকালীন ৪দলীয় জোট সরকার এই ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। এতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান সহ ২৪জন নিহত হন। বিচারের স্বার্থে সময় কিছুটা বিলম্ব হলে কোন সমস্যা নেই বলে তিনি জানান।

এ মামলায় ৯৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে ৯৭ তম সাক্ষীর জবানবন্ধী শেষ, জেরা চলমান অবস্থায় আছে। এ মামলার সাক্ষী সংখ্যা মোট ৪৯১ জন। আসামির সংখ্যা ৫২ জন। এর মধ্যে জেল হাজতে আছে ২৫জন , জামিনে আছে ১৯ জন ও পলাতক আছে ৮ জন।

পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন এজলাসে ঢাকার ১নং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শাহেদ নুর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচারকাজ চলছে।

গ্রেনেড হামলার পর মতিঝিল থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক শরীফ ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় মোট তিন দফা তদন্তে ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তাকে (আইও) পরিবর্তন করা হয়।

আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। সে লক্ষ্যে যতোদিন সময় লাগে লাগবে। তাই বিচার শেষ হওয়ার ব্যাপারে নির্দিষ্ট সময়সীমা বলা যাচ্ছে না।

মামলাটির বিলম্বিত বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, তদন্ত ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বার বার এবং অধিকতর তদন্তেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এ মামলার কিছু আসামি ১০ ট্রাক অস্ত্র, যুদ্ধাপরাধ, রমনা বটমূল ও ৭৬ কেজি বোমার মামলারও আসামি। তাই ওই মামলাগুলোর বিচারও এক সঙ্গে চলায় সময় নষ্ট হয়েছে। এছাড়া আসামিপক্ষ থেকে সাক্ষীদের অপ্রয়োজনীয় জেরা করায়ও সময় নষ্ট হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

মামলার অন্যতম আসামি তারেক রহমানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, তারেক রহমান এ হামলার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক হয়রানির জন্যই পরবর্তীতে তাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে।

প্রথম দফায় গ্রেনেড সংগ্রহ ও সরবরাহকারী, আক্রমণের পরিকল্পনাকারী আসামিদের শনাক্ত এবং অন্তর্ভূক্ত না করেই ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট ফজলুল কবির। এ অভিযোগপত্রে মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০০৯ সালের ৯ জুন পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল।

কিন্তু ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনক্রমে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এবার মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ।

তিনি ২০১১ সালের ৩ জুলাই প্রথম অভিযোগপত্রের ২২ জন ছাড়াও তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

২০১২ সালের ১৮ মার্চ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সম্পূরক চার্জশিটের ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে পুনরায় বিচার শুরু হয়। দেড় বছরে মাত্র ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করতে সক্ষম হন রাষ্ট্রপক্ষ।
জানাগেছে, জঘন্যতম ঘটনার ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই গ্রেনেড হামলার বিচার গত বছর শেষ করার ইচ্ছা থাকলেও নানামুখী সংকটের কারণে তা করতে পারেনি তৎকালীন মহাজোট সরকার। ধীরগতিতে মামলার প্রক্রিয়া চলতে থাকায় বিচারকাজের সামান্য অগ্রগতি হয়। এতে বিচারের প্রতীক্ষায় থাকা আহত ও নিহতদের পরিবারের স্বজনদের মাঝে এ নিয়ে আছে সংশয় আর হতাশা।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার্জশিটে অতিরিক্ত সাক্ষীর নাম উল্লেখ থাকায় মামলার বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, প্রসিকিউশন কোনো সাক্ষীকে গুরুত্বহীন মনে করলে তার সাক্ষ্য নাও নিতে পারেন, এ ক্ষমতা তার রয়েছে। অতিরিক্ত সাক্ষী এবং আসামিদের অন্য মামলায় বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়ার কারণে ২১ আগস্ট মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছিল ধীরগতিতে।
সরকার পক্ষের আইনজীবীরা বলেন, এ মামলায় যারা আসামি তারা সারা দেশে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি। কাজেই দেশের অন্যান্য আদালতেও আসামিদের নেওয়া হয়। ফলে ২১ আগস্ট হামলার বিচারিক ট্রাইব্যুনালের পক্ষে টানা বিচারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ তার সহযোগীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত।

সেখানকার মামলায়ও তাদের হাজির করা হয়। আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ে মৃত্যুদ- হয়। আবদুস সালাম পিন্টু নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলা মামলার আসামি। চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে লুৎফুজ্জামান বাবরের মৃত্যুদ- হয়।

বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট আবু আবদুল্লাহ ভুঁইয়া আরও বলেন, এ ছাড়া আসামি পক্ষেরও মামলার বিচার বিলম্বিত করার একটা প্রবণতা রয়েছে।

মামলার দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপারে সরকারপক্ষের প্রধান কৌসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, কেবলমাত্র মাজেদ বাটের স্ত্রী কাকনের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আসামি পক্ষের আইনজীবীদের বিরোধিতার জন্য ৯৯ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে।

এদিকে মুফতি হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬৮, আবদুর রউফের জন্য ১০ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে।এ জন্যই মামলার বিচারিক কার্যে সময় লাগছে। তবে মামলা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাকি সাক্ষীদের মধ্যে মামলা প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীসহ আরও ২৫ থেকে ৩০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হতে পারে।
সরকারপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, ইতোমধ্যে মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান,আবু তাহের, তাজউদ্দিন, মাজেদ বাটসহ জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নারকীয় ২১ আগস্টের এ হামলার তদন্ত করতে গিয়ে আট বছর ধরে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে পুলিশকে। এ সময়ে তদন্ত হয়েছে তিনবার। আর তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয় ছয়বার।

মহাজোট সরকার আমলে সিআইডির সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট স্মরণকালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
অভিযোগপত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, তৎকালীন

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ নতুন করে ৩০ জনকে আসামি করা হয়। নতুন করে ৩০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২।

২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া প্রথম চার্জশিটে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়েছিল।

সূত্র জানায়, আগের অভিযোগপত্রে হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডের উৎস, মজুদ, সরবরাহকারীও পরিকল্পনাকারীদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে আর্জেস গ্রেনেড পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছে। তা পাকিস্তানি নাগরিক মজিদ বাটের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন সাবেক মন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন এবং হামলাকারীদের মধ্যে বিতরণ করেন।

এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার তদন্ত শেষ হয়। এতে ৩০ জনকে আসামি করা হয়।

প্রথম অভিযোগপত্রে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুসহ ৪০৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। আলামত জব্দ দেখানো হয়েছিল ৬৯ ধরনের।

মামলার ৫২ আসামির মধ্যে খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম জামিনে আছেন।

সাবেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২৫ জন আসামি কারাগারে আটক আছেন।
অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির

বর্তমান এমপি কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জন আসামি পলাতক আছেন।

মামলায় এ পর্যন্ত আট জন আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন- মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ।

ঢাকা জার্নাল,আগস্ট ২০, ২০১৫।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.