এই চুমু বিপ্লবের নয়, হঠকারিতার

নভেম্বর ৮, ২০১৪

1910619_67676641498_2524669_nকাবেরী গায়েন: দুঃখিত। পশ্চিমবঙ্গের ফ্যাশন-দুরস্ত ‘চুমু-বিপ্লব’কে স্বাগত জানাতে পারছি না বলে। এই জাতীয় হঠকারী তথাকথিত আন্দোলন গ্রাম থেকে কত লড়াই করে শহরে পড়তে আসতে চাওয়া মেয়েটার পড়তে আসা যে ঠেকিয়ে দেবে! যে দেশে আজো কন্যা সন্তানের জন্ম ভ্রুণেই নিঃশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা হয়, সেই দেশে এইসব আন্দোলন না প্রতিনিধিত্ব করে দেশের সাধারণ মানুষকে না বিবেচনা করে নিম্নবিত্ত বা গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েটির পড়তে বা কাজে আসার লড়াই। ইতিমধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন এই ‘চুমু-হঠকারিতা’য় পড়ে দিকভ্রষ্ট মর্মে খবর আসছে।

আমার প্রিয় এক ছাত্রী, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের। বোরখায় ঢেকে আসতো বলে এমন ডিপার্টমেন্টে একটু কুন্ঠিত থাকতো। আমার সাথে থিসিস করার সূত্রে নানা কথার আদান-প্রদান হতো। মেয়েটা দেখতাম সাহিত্যের খুব ভক্ত, রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। কথায় কথায় জানালো একদিন সে যদি বোরখা না পড়তো তবে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতে পারতো না। আর তখন বোরখা পরা ছেড়ে দিলে ওর কাজিনরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারবে না। আমার সেই ছাত্রী এখন একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর বোরখা আমার জন্য কোনদিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং আমাকে মেয়েদের লড়াই-এর অন্য একটি জায়গা সম্পর্কে বুঝতে শিখিয়েছে। ইরানের নারীরা শুধু হিজাবকে স্বীকার করে নিয়েছে রাষ্ট্রের সাথে তাঁদের অন্য অনেক বোঝাপড়ার হাতিয়ার হিসেবে।

97543_1একথা ঠিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যেসব নারীরা পড়তে আসতেন, তাঁদের প্রবণতা ছিলো আধুনিক বাঙালি সাজের দিকে। আমার মনে হয় তার অন্যতম কারণ বোধহয়, সেসময় মূলত শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার সুযোগ পেতেন। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। অনেক প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরাও সাহসে ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছেন। অনেকের ক্ষেত্রেই বোরখা বা হিজাব থাকে এই শহরে পড়তে আসার আপোস-চিহ্ন হিসেবে। মেয়েদের লড়াই-এর এই দিকগুলো বিবেচনায় নিতে না পারলে অনেক বোঝা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে।

সমাজ-বিচ্ছিন্ন, ফ্যাশন-দুরস্ত হঠকারিতা আর প্রগতিশীলতা বোধহয় ভিন্ন।
আমি যে তথাকথিত ‘চুমু-আন্দোলন’কে সমর্থন করতে পারলাম না, সেজন্য মোটেই বিব্রত নই। হঠকারিতা আর আন্দোলনের পার্থক্য না বুঝলে অনেক অর্জনই ধরে রাখা যায় না। এই হঠকারিতার মূল্য নেতিবাচকভাবেই দিতে হবে বলে আশঙ্কা করছি, যার শিকার হবেন সাধারণ মেয়েরা, যা হয়তো অনেক ক্ষেত্রে লোকচোখের আড়ালেই থেকে যাবে। আন্দোলনের অভিনবত্ব সবসময় আন্দোলনের অন্তঃসারশূন্যতাকে ঢাকতে নাও পারে।

 কাবেরী গায়েন, শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.