বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল

জুন ১৬, ২০১৩

শীতপ্রধান দেশের বা অন কোন দেশের কবির কাছে বর্ষার এমন কদর নেই বর্ষাকে তাঁরা ভালভাবে চেনেনই না, জানেনই না এটাই স্বাভাবিক তাই সারা পৃথিবীর একমাত্র বাংলাদেশেই অর্থাৎ সমগ্র বাংলায় বর্ষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হয় এটাই বাংলার গর্ব ও ঐতিহ্য এবং আলাদা বৈশিষ্ট।

kodom-1

রবীন্দ্রনাথের “বর্ষামঙ্গল” এবং কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্য গ্রন্থের কথা স্মরণ না করলে যে বর্ষার আলোচনাই যে বৃথা।

ফারুক ওয়াহিদ, ম্যানচেস্টার, ক্যানেটিকাট থেকে, ঢাকা জার্নাল: বৃষ্টি হোক আর নাই বা হোক আজ ঋতুর রানী বর্ষার প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা আষাঢ়- কদম ফুল ফুটুক আর নাই বা ফুটুক আজ রোমান্টিক ঋতু বর্ষা বরণের প্রথম দিবস- ময়ুর পেখম মেলুক আর নাই বা মেলুক আজ কবিতার ঋতু বর্ষা উৎসবের প্রথমদিন।

‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল করেছ দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’

-রবীন্দ্রনাথের বর্ষার এ ধরণের আবেগময় গান পৃথিবীতে শুধু বাঙালিদের জন প্রযোজ্য -বর্ষা ঋতুযে শুধু বাঙালির ঋতু, কবিদের ঋতু, নজরুল-রবীন্দ্রনাথের ঋতু। রোমান্টিক ঋতু বর্ষা এই প্রবাসে-পরবাসে নীরবে-নিভৃতে চলে এসেছে। পৃথিবীর আর কোথাও ঋতু হিসাবে বর্ষার কোন স্বতন্ত্র পরিচয় বা নাম নাই যা একমাত্র ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে তথা বাংলায় রয়েছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ষড়ঋতু যেটা হয়েছে একান্ত প্রকৃতিগত কারণে এবং এটাই হল বাংলার ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্।

বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ! কল্পনাই করা যায় না। বর্ষা হল একা, একমাত্র তার জুড়ি নেই- বর্ষা হল বাঙালিদের শুধু বাঙালিদের ঋতু, কবিদের ঋতু, কবিতার ঋতু, প্রেমের ঋতু, আবেগের ঋতু, প্রিয়জনকে সান্নিধ্যে পাবার আকাঙ্ক্ষার ঋতু। এই বর্ষায় ভালবাসিবার সাধ জাগে, বথিত-বঞ্চিত জীবনকে সে ভরে দিতে চায় ঘ্রাণে- এতো দুঃখের মধেও মনে হয় জীবনে এত সুখ! বর্ষাকে নিয়ে এত কবিতা, এত ছড়া, এত গল্প. এত কাব্য গ্রন্থ, এত উপন্যাস-উপাখ্যান পৃথিবীর আর কোন ভাষায় বা সাহিত্যে হয়নি যেটা হয়েছে বাংলা ভাষায় বা সাহিত্যে- তাই এক কথায় বলা যায় বাংলা কাব্য বর্ষাময়।

শীতপ্রধান দেশের বা অন কোন দেশের কবির কাছে বর্ষার এমন কদর নেই বর্ষাকে তাঁরা ভালভাবে চেনেনই না, জানেনই না এটাই স্বাভাবিক তাই সারা পৃথিবীর একমাত্র বাংলাদেশেই অর্থাৎ সমগ্র বাংলায় বর্ষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হয় এটাই বাংলার গর্ব ও ঐতিহ্য এবং আলাদা বৈশিষ্ট। রবীন্দ্রনাথের “বর্ষামঙ্গল” এবং কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্য গ্রন্থের কথা স্মরণ না করলে যে বর্ষার আলোচনাই যে বৃথা।

‘মেঘদূত’-এ বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা বর্ণিত রয়েছে আর রবীন্দ্র সাহিত্য-সঙ্গীত জুড়েই আছে বর্ষা। রবীন্দ্রসঙ্গীতে বর্ষা ঋতুটা রবীন্দ্রনাথ স্নিগ্ধ-শামল সুন্দর রপে বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’-এর পাতায় পাতায় বর্ষার ঘনঘটা। ‘নিঃসীম শনে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে’ আর এই শ্রাবণ মাসেই বর্ষাপ্রেমিক বিশ্বকবির মহাপ্রয়াণ দিবস এবং এই শ্রাবণের কৃষ্ণ মেঘের ভেতরই তিনি অমর হয়ে আছেন। প্রবাসে সংস্কৃতমনা বাঙালি সংগঠনগুলো খুবই সুসংগঠিত তারাই পারে বাংলার ষড়ঋতু গুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নিতে এতে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্ম বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিগুলোকে জানতে পারবে এবং বিদেশীরাও আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাবে যাতে করে তাদের কাছে সংস্কৃতমনা বাঙালির কদর অনেক বেড়ে যাবে।

প্রবাসে তথা উত্তর আমেরিকায় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস তথা জুন-জুলাইয়ে সর্যাস্ত হয় রাত ৮টার পর তাই এখানে সন্ধ্যা কখন? বর্ষাকাল বলতে তাদের কোন ঋতুই নেই। বাঙালি সংস্কৃতিতে অপরাহ্ন সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সময়কে সন্ধ্যা বলা যায় কিন্তু সূর্যের আলোসহ রাত ৮টা-৯টা-কে তো আর সন্ধ্যা বলা যায় না। তাই এই প্রবাসে বর্ষণমুখর সন্ধ্যা থাকুক আর নাই বা থাকুক বা বর্ষা ঋতু থাকুক আর নাই বা থাকুক, বৃষ্টি হোক আর নাই বা হোক, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল ফুটুক না ফুটুক আমি বলেই যাব এখন রোমান্টিক ঋতু বর্ষাকাল এবং এই ঋতু শুধু বাংলাদেশের তথা বাঙালির একান্ত নিজস্ব।

‘বর্ষণমুখর সন্ধ্যা বা রাত’-এর রোমাঞ্চিত আমেজ কি এই প্রবাসে থেকে একজন বাঙালি হিসাবে কখনও কি ভুলা যায়! কারণ আমাদের শিকড় যে বাংলাদেশে- তাই যেখানেই থাকিনা কেন আমরা যে বর্ষাপ্রেমী বাঙালি। কারণ পৃথিবীর কোনো জাতি নিজস্ব বা এককভাবে কোনো একটি ঋতুকে তাদের একান্ত বা নিজস্ব ঋতু বলে দাবী করতে পারে না- বাঙালিই গর্বের সাথে বলতে পারে বর্ষা ঋতু হল একমাত্র বাঙালিদের এবং শুধু বাঙালিদের- যেটা অন্য কোনো জাতি কোনোদিন এই দাবী করতে পারবে না- কারণ তাদেরতো বর্ষা বলতে কোনো ঋতুর নামই নেই!
“এমন দিনে তারে বলা য়ায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়।”

কী বলা যায়, তা ভেবে পাওয়া যায় না। এমন দিনে সব অনুভব করা যায় এবং মনের দুয়ার খুলে যায়, হৃদয় খুলে যায়, হৃদয় নেচে উঠে; এ যেন-
‘মন মেতেছে মনময়ুরীর কি খেলায়/নাম না জানা ফুল ফুটানোর এই বেলায়।’

আষাঢ় শ্রাবণের বর্ষণমুখর অশ্রুময়ী রজনীতে ধরিত্রীর প্রকৃতি সজল মেঘের বারিধারায় সজীব ও সতেজ হয়ে উঠে। গোধুলির পর অজস্র করুণার অমৃতধারার আবির্ভাব হয় সংগীতের অপূর্ব সূর-মূর্ছনায় যা আমাদের মনের আকাশটাকেও মেঘ মাধুর্যে পরিপূর্ণ করে তাকে কোমল ও সিক্ত করে তোলে এবং মনের কিনারা ছুঁয়ে যায় কী সব অজানা অনুভতি-

“আজিকার ঝরমুখর বাদল দিনে,/ জানিনে, জানিনে, কিছুতে কেন যে মন মানে না।”

আঁধারের আঁচলে সূর্যের চোখ বেঁধে রেখে মেঘরাজি গুরুগম্ভীর গর্জন করে চপলা বিদুৎ-স্ফুরণ এর আলোক-সজ্জার খেলা শুরু হয়, এই মেঘ মাধুর্য সতিই অনিবর্চনীয়। আর তাইতো করি গুরুরও মনও

“পাগলা হাওয়ায় বাদল-দিনে/ পাগল আমার মন জেগে উঠে।”

বর্ষণ মুখর রজনী যেন কবরী এলিয়ে নীলাম্বরি পরিধান করে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের নিচে বসে থাকে। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কাংক্ষিত রমণীর মত প্রিয় অদর্শনে অভিমান ক্ষুব্ধ বর্ষণ সিক্ত রজনী ম্লান নিষ্পলক চেয়ে থাকে। সুন্দরী বিরহিনী ললনার মত ধরণীও প্রিয় দর্শনে বাকুলা অশ্রুময়ী হয়ে পড়ে। মেঘবাষ্প হতে বারিধারা শতধারায় প্রবল বর্ষণে পর্বত, শস্য, প্রান্তর ও বনভুমি প্লাবিত করে তার মধ্য ঘনিয়ে আসে পুষ্প বিকাশের আনন্দঘন পরম লগ্ন। বেণুবন এবং অর্ধস্ফুট কেতকি ফুলের ছিন্ন পুষ্পগুচ্ছ মাটিতে লুটোচ্ছে।

বর্ষণসিক্ত রজনীতে প্রস্ফুটিত কদম্ব ফুল উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে। জুঁই-গন্ধরাজ-কামিনী-হাসনাহেনার সুস্নিগ্ধ সমীরণে জলের কলোচ্ছাসে, কুঞ্জের পত্র-মর্মরে বর্ষা-প্রকৃতির উন্মুখ হৃদয়ের কি অনবদ্য প্রকাশ। বর্ষণ মুখর রাতের কাজলকালো আঁখির স্বপ্নরেখায় তমালের পাতা যেন আরো নিবিড় কালো হয়েছে। বর্ষার জলে একটানা ভেকের আলাপন আর ঝিঁ ঝিঁ-র আগমনসংগীত রাত্রির আকাশকে মুখরতা দিয়েছে হৃদয় দিয়ে। আর তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন

“রজনী শাওন ঘন ঘন দেওয়া গরজন/ রিমিঝিমি শব্দে বরিষে।”

এমন দিনে সব অনুভব করা যায় এবং মনের দুয়ার খুলে যায়, হৃদয় খুলে যায়, হৃদয় নেচে উঠে। কবির ভাষায় বলতে হয়- “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ ময়ুরের মত নাচেরে।”

বর্ষণমুখর রাতের অঝোর ধারার মধে যেন শোনা যায় নৃত চপলা নারীর পায়ের শিঞ্জন। এ সিক্ত রজনীতে বসুন্ধরা যেন নিঃসাড় ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, আনমনা হয় মানব হৃদয় এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অবক্ত বেদনায় মন কাতর হয়ে পড়ে না আসা প্রিয়ের জনে। এ বর্ষণ ধারা প্রেমিক-মাত্রেরই হৃদয়কে আবিষ্ট করে এবং এক আশ্চর্য পুলকানুভতিতে তার হৃদয় মনকে করে তোলে চঞ্চল। যক্ষের প্রেয়সী যেভাবে প্রভু শাপে অভিশপ্ত প্রেমিক যক্ষের জন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কাঁদে বর্ষণ মুখর রাতও তেমনিভাবে ক্রন্দন করে।

বিরহিনী যক্ষ প্রিয়া না আসা প্রেমিকের জন যেভাবে অভিমান ও বথায় বেদনার্ত হয়ে উঠে তেমনি বৃষ্টিভেজা রাতও অভিমানে মুহমান হয়ে উঠে। আর তাইতো বর্ষণমুখর রজনীতে বসুন্ধরার প্রেমিকদের কত স্বপ্ন, কত শাশ্বত কল্পনা কবি কুঞ্জের কত প্রশস্তি কত সংগীত। বর্ষণ মুখর রজনীতে বাংলার কবি হৃদয়ের মুখ খুলে যায়। তাঁদের ভাবের ময়রপঙ্খির পালে লাগে জলসিক্ত পুবালি হাওয়া এবং কাল্ট ক্ষেত্রে চলতে থাকে রসের অবিশ্রান্ত ধারা বর্ষণ, সংগীতে লাগে নবীন সুরের আমেজ, আসে সৃষ্টির আমেজ, আসে সৃষ্টির জোয়ার। বর্ষা-প্রেমী নজরুলতো বলেই গেছেন, “শাওনে যাহারে পেলেনা/ তারে কি ভাদরে পাইবে দেখা!।”
farouk20130615094440
 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.