বাবার দরবারে পৌঁছে না সম্রাটের কান্না

ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৩

Sahali-Nazmul-1020130201192946এস এম আববাস: 

“আংকেল, সিগারেটটা দেবেন?” মধ্যরাতে কথাটা কানে আসতেই চমকে উঠি। পাশ ফিরে দেখি, ধুলোর মধ্যে বসে আছে বছর ১৪ বয়সের এক কিশোর।

পায়ে ইস্পাতের বেড়ি পরা। খেয়াল করে দেখলাম, আসলে বেড়ি নয়। হাঁটুর নিচে মাংস আর হাড্ডির মধ্যে গেঁথে থাকা সারিবদ্ধ ইস্পাতের পাত।

কিন্তু শীতের মধ্যরাতে মিরপুরের শাহ আলী মাজারের গেটে কেনো এই কিশোর? কেনোই বা তীব্র শীতের মধ্যেও বাইরে ধুলোর মধ্যে বসে আছে? বাবা শাহ আলীর কাছে কি চাওয়া তার? ভাবলাম, পায়ের সুস্থতার জন্য হয়তো।
শাহ আলী copy
কিন্তু না। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, তার নাম সম্রাট। শুধু দুপুরের একবেলা খাবারের জন্য দিন-রাত এভাবেই কাটছে তার। ইতোমধ্যে কেটে গেছে তিন তিনটি মাস।
প্রচণ্ড শীতেও সামান্য জীর্ণ, ময়লা কাপড় পরে ধুলোর মধ্যে বসে থাকে সে সারারাত। শরীর নেতিয়ে পড়লে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম না আসলে জেগেই কাটাতে হয়। পায়ের ব্যথা আর শীতের কষ্টে প্রচণ্ড অস্থিরতা, ছটফটানি থামে না।

পাশেই পঞ্চাশোর্ধ স্বামীহারা ফাতেমা বেগম নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। দোকানের বারান্দায় শীতে ঘুমোতে পারছিলেন না তিনি। মধ্যরাতে সম্রাটের কাছে এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে দেখে এগিয়ে আসেন।

সম্রাট পা চুলকাচ্ছে আর অস্থিরতায় মাথা নাড়ছে। শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। এসময় বিধবা ফাতেমা বেগম এসে কিশোরটির পাশে এসে দাঁড়ালেন। সেটা ছটফটানি দেখেই, নাকি অজ্ঞাতপরিচয় লোক দেখে, তাৎক্ষণিক বোঝা গেলো না।

ছেলেটির এ অবস্থায় শাহ আলীর দরবারের আসা কোনো লোক তার সাহায্যে এড়িয়ে আসছে না কেনো? এমনটিই জানতে চাওয়া হয় ফাতেমা বেগমের কাছে। উত্তরে তিনি বলেন, “কেউ দেখে না। বাবার দরবারে মানুষ লাখ লাখ টাকা দেয়। আমাদের দেখার কোনো মানুষ নাই। সম্রাটের কান্নার শব্দও বাবার দরবার পর্যন্ত পৌঁছায় না।”

মাজারে শাহ আলীকে নিয়ে সামসেল হক বয়াতির গান, মাঠে জড়ো হওয়া একদল নারী-পুরুষের একসঙ্গে গাওয়া গান (অনেকটা জারি গানের মতো) শোনা হলো। শীতে কুঁকড়ে যাওয়া হতদরিদ্র মানুষের রাত্রিযাপনের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা হলো। এরপর রাতের ডিউটিতে সংবাদ লেখার তাগিদে অফিসে ছুটে যাবার পালা। রাত আড়াইটার দিকে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ‘আংকেল’ ডাকার মধ্য দিয়ে অভিনবভাবেই পরিচয় হয় সম্রাটের সঙ্গে।

ঝালকাঠির আবুল কালাম ও বেবী খাতুনের বড় ছেলে সম্রাট। প্রায় নয় মাস আগে সে নিজ এলাকায় টেম্পু দুর্ঘটনার শিকার হয়। দুর্ঘটনার পর প্রথমে ঝালকাঠি হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন তার-বাবা মা। এক পর্যায়ে চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পেরে আর সন্তানকে দেখতেও আসেননি তারা। সন্তানের মায়া ছেড়েছেন।

তবে দু:খ বিদায় হয়নি তাদের সন্তানের কাছ থেকে।

সম্রাটের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেলো, ছয়মাস সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পর পায়ে রড লাগানো অবস্থায় তাকে হাসপাতাল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ে তাকে আবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু আর যেতে পারেনি সে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে কোন একটি বাসে বিনা পয়সায় এসে নামে মিরপুর এক নম্বরে। অবশেষে তার জায়গা হয় শাহ আলী মাজারের গেটের বাইরে।

সারাদিন মাজারের গেটের আশেপাশে অনেক কষ্টে এদিক-সেদিক যায় সম্রাট। দুপুরে মাজারের খাবার খেয়ে সারাদিন কাটায়। মাঝে মধ্যে কেউ দয়া করে টাকা দিলে নেয়। টাকা চেয়ে কোনো লোককে বিরক্ত না করলেও সিগারেট চেয়ে নেয় নি:সংকচে। অস্থিরতা কাটাতে এটিই তার সব চেয়ে প্রিয় বস্তু।

রাতে সম্রাটের সঙ্গে শেষ কথা বলে চলে আসার সময় আবারও ডাকে সম্রাট, “আংকেল, সিগারেট দিয়ে যান।”

তখনও টাকা বা খাবার চয়নি সম্রাট। দুপুরে তো খাবারের পাট চুকে গেছে। কিন্তু অস্থির টানা সময় পার করার মতো আর কোনো জাদু তার জানা নেই।

অসহায় সম্রাটের অস্থিরতা আর কষ্ট দেখে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিলাম। পাঁচটি গোল্ডলিফ সিগারেট ও একটি ম্যাচ কিনে দিলাম তার হাতে। আর কিছু করার ক্ষমতা নেই, তাই হয়তো জেনেশুনেই বিষ তুলে দিলাম।

রাতভর মাজারের ছবি তোলেন বাংলানিউজের ফটো সাংবাদিক নাজমুল। রাতের ছিন্নমূল মানুষ কিভাবে শুয়ে আছে, শীতের তীব্রতা কমাতে কিভাবে আগুন পোহাচ্ছে- সেসব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেন তিনি।

মাজারের সব চেয়ে বড় টাকার বাক্স ও পাহারাদারের ছবিও ওঠানো হয়। মাজারের টাকার নিরাপত্তায় কতোটা সতর্ক রয়েছেন নিরাপত্তা কর্মীরা, তা ক্যামেরাবন্দি করা হয়। গেটের ভেতরে দান বাক্সে লাখ লাখ টাকা দেওয়ার মানুষ আছে, সে টাকার নিরাপত্তাও আছে।

শুধু কেউ নেই সম্রাটের মতো অসহায় এই কিশোরদের দেখার।

এস এম আববাস, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৩

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.