হ্যাপি নিউ ইয়ার টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান।। মাসকাওয়াথ আহসান

জানুয়ারি ১, ২০২১

জুড়িগাড়ী থেকে টাকার বস্তা এনে পেঁজা তুলোর মতো বাগান বাড়ির আকাশে উড়িয়ে দেয়া হয়; বারোটা এক মিনিট; অতিথিদের ফোনগুলোতে ভক্তদের “হ্যাপি নিউ ইয়ার তোলে”। কিন্তু হেমলক সোসাইটি তখন প্রাণপণে টাকার গন্ধ নিতে ব্যস্ত। অথচ গন্ধের কোন দেখা নেই

বন ফায়ারের আগুন হিস হিস করে জ্বলতে থাকে। বাগানবাড়িতে আলো আঁধারির রহস্যে একে একে এসে থামতে থাকে ঢাউস জুড়িগাড়ি; তার পেছনে পিন পিন শব্দ করে এসে দাঁড়ায় প্রোটোকলের স্লেইজ গাড়ি; তাতে শীতে জবু থবু দেহরক্ষীরা।

ঢাউস জুড়িগাড়িগুলো থেকে একে নামতে থাকে অতিথি পেঙ্গুইন আর এস্কিমোরা। বাগানবাড়ির শান বাঁধানো উঠোন জুড়ে পরিসংখ্যানের আলপনা। দেয়ালে আলো আর আলেয়ার নয়নাভিরাম সংখ্যা শিল্প। নিরাপদ দূরত্বে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো করে সাজানো সংরক্ষিত নৈশ আসনগুলো।

সীমিত পরিসরে ইংরেজি নববর্ষ বরণের এই সাঁঝে একটা কোন জীবনদায়ী সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। কিন্তু কী সেই সারপ্রাইজ তা এখনো জানানো হয়নি। অতিথিরা চেয়ারে বসতে বসতেই শুরু হয় ছেঁড়া ছেঁড়া গল্পগুলো। করোনা বর্ষটিতে গল্পগুলো আর জমাট বাঁধে না; প্রসঙ্গগুলো অনায়াসে ঠেলে আসে না; অনেকটা জোর করে একাদিক্রমে কথা বলে চুপ করে যাওয়া; আর জুম বৈঠক করে করে তো চোখে চোখ রেখে কথা বলার অভ্যাসই হারিয়ে গেছে যেন।

কে একজন যেন বলে ওঠেন; আজ আমরা করোনা প্রসঙ্গে কোন কথা বলবো না; নতুন গল্প হোক; কিংবা নতুন কোন কথা। কিন্তু তবুও মনের অজান্তেই এক একজন করোনা বিশেষজ্ঞের মতো কথা বলতে শুরু করে। তাদের থামানোর সাধ্য নেই কারো।

কে একজন হাঁক দেয়, এই আসরে কি কোন কবি নেই; যে নতুন কোন কবিতা শোনাতে পারে।

আছে; পকেটের পাশে সেনা-কর্তার মতো পদক লাগানো কবি আছে। কিন্তু কী কারণে যেন কবিতা অভিমান করে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার স্মৃতি থেকে সে দু’চারটি ছত্র বলতে চেষ্টা করলে; কে একজন যেন বলে, ওসব ঢের শোনা হয়েছে; বরং গান হোক; এই আসরে কী কোন গায়ক নেই!

আছে; আঁচলের পাশে পুলিশ-কর্তার মতো পদক লাগানো গায়িকা আছে। কিন্তু কী কারণে যেন সুর অভিমান করে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার স্মৃতি থেকে সে দু’এক কলি গাইতে চেষ্টা করলে; রবীন্দ্রনাথ যেন গম্ভীর মুখে ছায়ার মতো  বাগান বাড়ি থেকে হেঁটে বেরিয়ে যান।

কে একজন অগত্যা মোবাইল ফোন বাজিয়ে শোনায় কলিম শরাফীর গাওয়া গানখানি।

“পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে

সেই দুঃখে চোখেরও পানি

ও আমার চক্ষু নাই

পাড় নাই কিনার নাই রে

ও আমার চক্ষু নাই

ঘর নাই ও মোর জন নাই

তবু দিলাম ভাঙ্গা নায়ে

অথৈ সায়র পাড়ি

পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে

সেই দুঃখে চোখেরও পানি

ও আমার বৈঠা নাই

ও আমার সুখ নাই

নিদ নাই চোখে নিদ নাই

বিধিরে তোমার খেয়ালের শেষ নাই

দয়া নাই তোমার মায়া নাই

তবু জনম দুঃখি আমি

তোমায় আপন জানি

পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে

সেই দুঃখে চোখেরও পানি

ও আমার চক্ষু নাই”।

উপস্থিত অতিথিদের মন বিষণ্ণ হয়। কে একজন হাঁক দেয়, এই আসরে কী কোন পরিসংখ্যানবিদ নাই; যে আমাদের একটু উজ্জীবিত করতে পারে।

আছে; বাগানবাড়ির আলপনায় পরিসংখ্যান আছে; দেয়ালের আলো-আলেয়ায় সংখ্যার উদ্দীপনা আছে। একজন টেকস্যাভি পরিসংখ্যানবিদ তবু দাঁড়িয়ে শুন্যে আঙ্গুল বুলিয়ে হাওয়ায় নীলাভ রং-এর পরিসংখ্যান ভাসাতে থাকে জাদুকরের মতো।

কে একজন হাঁক দেয়; পরিসংখ্যানে কী পেট ভরবে! আজ কী খাওয়া দাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই!

আছে; স্বপ্নের রোস্ট আছে; আবেগের রেজালা আছে; রেশমি কাবাব আছে; ভালোবাসার পোলাও আছে; প্রেমের স্বামী কাবাব আছে; স্বাস্থ্য সচেতনার সালাদ আছে।

সবাই গোগ্রাসে খেতে শুরু করে; কিন্তু সুগন্ধী খাবারে কেউ-ই যেন কোন গন্ধ পায়না। কে একজন বলে, ঠান্ডায় নাক বন্ধ হয়ে গেলো নাকি!

–তাই বলে সবার নাক বন্ধ হয়ে গেলো নাকি; একী ব্যাঙের সর্দি!

কে একজন হাঁক দেয়, এ আসরে কী একজনও ডাক্তার আছে?

আছে; পকেটে ভরসা ভর্তি হাস্যজ্জ্বল ডাক্তার আছে; কিন্তু সেও স্বাস্থ্য সচেতনার সালাদে কোন গন্ধ না পেয়ে নার্ভাস। কাঁপতে কাঁপতে সে বলে, পকেট থেকে টাকা বের করে গন্ধ নিন; সবচেয়ে পরিচিত গন্ধ; এ গন্ধটুকু পেলেই আমরা নিরাপদ।

জুড়িগাড়ী থেকে টাকার বস্তা এনে পেঁজা তুলোর মতো বাগান বাড়ির আকাশে উড়িয়ে দেয়া হয়; বারোটা এক মিনিট; অতিথিদের ফোনগুলোতে ভক্তদের “হ্যাপি নিউ ইয়ার আর্তনাদ তোলে”। কিন্তু হেমলক সোসাইটি তখন প্রাণপণে টাকার গন্ধ নিতে ব্যস্ত। অথচ গন্ধের কোন দেখা নেই।

কে একজন আর্তনাদ করে, এ আসরে কী কোন অক্সিমিটার আছে!

আছে; কিন্তু তাতে অক্সিজেনের মাত্রা ৮৭-৮৬-৮৫-৮৪-৮৩-৮২ হয়ে লাল বাতি জ্বলে যাচ্ছে। শ্বাসযন্ত্রগুলো ক্রমেই ক্ষমতার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

এমন সময় বাগান বাড়ির গেট দিয়ে একজন পবিত্র শুভ্র দরবেশ প্রবেশ করেন সান্তাক্লজের মতো সারপ্রাইজের লাল পোটলা নিয়ে। প্রসন্ন হাসিতে তিনি বলেন, ভ্যাকসিন মুবারক; সৃষ্টিকর্তা আমাকে আপনাদের জীবন দানের জারিয়া বানিয়েছেন; বলুন আমিন।