একজন ফটো সাংবাদিক এবং ইয়াবার গল্প

জুলাই ৮, ২০১৭

রাফসান জানি : ফটো সাংবাদিক আসিক মোহাম্মদ কাজ করেন ডেইলি অবজারভারে। বাবা অসুস্থ প্রবীণ ফটো সাংবাদিক ফরহাদ হোসেন। মা গৃহিনী। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আসিক মধ্যরাতে রাজধানীর রামপুরায় একটি অনুষ্ঠান শেষে দক্ষিণ বনশ্রীর বাসায় ফিরছিলেন। রামপুরা থেকে বনশ্রী রাস্তা খারাপ থাকায় তিনি শান্তিনগর হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে শান্তিনগর বাজারের বিসমিল্লাহ হোটেলের সামনে তাকে আটকায় পল্টন থানার টহল পুলিশ। এরপর পুলিশ তাকে তল্লাশি করে। তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন। কিন্তু কিছু না পেলেও  পুলিশ তাকে আটক করেছে বলে জানান আসিকের স্বজনরা। তারা আরও জানান, পরবর্তী সময়ে আসিক ছাড়াও ভিন্ন ভিন্নস্থান থেকে আটক আরও দুই জনের বিরুদ্ধে ইয়াবা রাখার অভিযোগ এনে মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ।

ঘটনাটি ঘটে ঈদুল ফিতরের পরদিন গত ২৭ জুন দিবাগত রাতে। সাংবাদিক আসিক মোহাম্মদের মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘যেদিন আসিককে পুলিশ আটক করে ওইদিন রাতে বন্ধুদের আয়োজিত ঈদ-পরবর্তী একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন আসিক। অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শান্তিনগর বাজার এলাকায় পুলিশ তার ছেলেকে আটক করে। এরপর ছেড়ে দেওয়ার শর্ত হিসেবে এক লাখ টাকা দাবি করে। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় আসিককে পকেটে ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে মামলা দিয়েছে।

পুলিশের এজাহারে উল্লেখ করা হয়, রাত ৪টা ২০ মিনিটে আসিকসহ তিনজনকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তখন তল্লাশি চালিয়ে আসিকের পকেট থেকে ১০টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। এছাড়া অন্য দু’জনের মধ্যে একজনের পকেটে ১০টি ও অন্যজনের কাছ থেকে ৫টি ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ২৮ জুন সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে পল্টন থানার এ এস আই আশরাফ আলী বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অন্য দুই আসামি হলেন আল-আমিন খন্দকার তন্ময় ও আসিফ আলী।

মামলার আরও উল্লেখ করা হয়, ২৮ জুন ভোর রাত ৪টার দিকে ইস্টার্ন প্লাস মার্কেটের সামনে অবস্থান করার সময়  রাত আনুমানিক ৪টা ১০ মিনিটের সময় গোপন সংবাদে জানতে পারি, শান্তিনগর বাজার এলাকায় কতিপয় মাদক ব্যবসায়ী নেশা জাতীয় মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে। এরপর হোটেল বিসমিল্লাহর সামনে পৌঁছামাত্র তিন যুবক আমাদের উপস্থিতির টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাদের আটক করি। এ সময় আটককৃত আল-আমিনের বাম হাতে পলিথিনে মোড়ানো ১০ পিস, আসিক মোহাম্মদের প্যান্টের ডান পকেট থেকে ১০টি ও আসিফ আলীর প্যান্টের বাম পকেট থেকে ৫টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করি।’

মামলা দায়েরের পর এর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় থানার এসআই মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। তিনি আসামিদের আদালতে হাজির করে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। ওই রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামিরা পল্টন থানাসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা করে। সময় স্বল্পতার কারণে আসামিদের দেওয়া নাম-ঠিকানা, ইয়াবার উৎস, যোগান দাতার নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। এজন্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। কিন্তু আদালত রিমান্ড আবেদন বাতিল করে আসামিদের জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।

কারাগারে গিয়ে সাংবাদিক আসিক মোহাম্মদের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও সহকর্মীরা দেখা করেছেন। তাদের মধ্যে আসিকের মামা মোহাম্মদ বাচ্চু বলেন,  আসিক তাকে বলেছেন, ‘রামপুরায় বন্ধুদের নিয়ে একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান ছিল। সেটার আয়োজকদের একজন ছিলেন আসিক। ২৮ জুন রাত সাড়ে ১২টার দিকে মোটরসাইকেলে চড়ে বনশ্রীর বাসায় ফিরছিলেন। পথে শান্তিনগর বাজার এলাকায় পৌঁছালে প্রথম দফায় পুলিশ তার গতিরোধ করে। সাংবাদিক পরিচয় দিলে পুলিশ তাকে গালি দেয়। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর সেখান থেকে আরেকটু সামনে গেলে টহল পুলিশের আরেকটি দল তাকে আটকিয়ে তল্লাশি করে। তখন পুলিশের ওই দলের সঙ্গে আসামি আল-আমিন আগে থেকেই ছিল। তল্লাশির একপর্যায়ে আসিকের সঙ্গে থাকা মোবাইলফোন ও মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নেয় পুলিশ। এরপর গাড়িতে তুলে বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে পল্টন থানায় নিয়ে যায। এরই মধ্যে রাত ৪টার দিকে তৃতীয় আসামি আসিফ আলীকে আটক করে নিয়ে আসে পুলিশ। তবে, আটককৃত বাকি দু’জন তার পরিচিত নন বলে আসিক তার মামাকে মোহাম্মদ বাচ্চুকে জানিয়েছেন।
রামপুরা থেকে আসিক কেন শান্তিনগর হয়ে বাসায় ফিরছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তার মামা মোহাম্মদ বাচ্চু বলেন, ‘রামপুরা থেকে বনশ্রীর রাস্তা খারাপ থাকায় তিনি শান্তিনগর হয়ে দক্ষিণ বনশ্রী ফিরছিলেন।’

ফটোসাংবাদিক আসিকের মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘ফজরের আজানেরর পর-পর আমার ছেলে ফোন করে জানায়, পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেছে। কী কারণে নিয়ে আসছে জানি না। আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করছে। না হয় ইয়াবা দিয়ে মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে।’ এই সংবাদ পাওয়ার পর আসিকের ছোটবেলার বন্ধু আল-আমিনকে থানায় পাঠান তিনি।

আল-আমিন বলেন, ‘আমি ভোর ৬টার দিকে থানায় গিয়ে আসিকের সঙ্গে দেখা করি। তখন সে খুব কান্না করছিল। ওকে নাকি মারধরও করা হয়েছে। ও বলছিল আমি কিছু জানি না। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যা।’

তখন আল-আমিন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা জানায়, ‘এখন চলে যান। সকাল ৮টার পর আসুন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এলে কী করা যায়, দেখব। এরপর সকাল ৯টার দিকে থানায় গেলে আল-আমিনকে জানানো হয়, ইয়াবা ব্যবসার অপরাধে আসিকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে কারাগারে আসিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বলেছেন ডেইলি অবজারভারের সাংবাদিক মো. মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ‘আসিক তাকে জানিয়েছেন, রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় শান্তিনগর বাজারে পুলিশ প্রথমে একবার আটকায়। তখন কথা কাটাকাটি হয়। একটু সামনে আসলে আবারও পুলিশ তাকে আটক করে তল্লাশি চালায়। পরে দাবি করা টাকা না দেওয়ায় ইয়াবা দিয়ে পুলিশ তাকে ফাঁসিয়ে দেয়।’

ডেইলি অবজারভারের প্রধান প্রতিবেদক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) যুগ্ম মহাসচিব পুলক ঘটক বলেন, ‘অবশ্যই ফটো সাংবাদিক আসিক নির্দোষ। কারণ, পুলিশের দায়ের করা মামলার বিবরণের সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ আসিককে আটক করেছিল মোটরসাইকেলসহ। কিন্তু মোটরসাইকেলের কথা এজাহারে ও জব্দ তালিকায় উল্লেখ নেই। পুলিশ তার মোবাইলফোন কেড়ে নিয়েছিল। সেটাও এজাহার কিংবা জব্দ তালিকায় নেই।’

পুলক ঘটক বলেন, ‘আটকের পর আসিক ডেইলি অবজারভারের ফটো সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাহলে তারা কেন অবজারভার অফিসে এ বিষয়ে খোঁজ না নিয়ে গোপন করা হলো। আসিকের মোবাইলের কল-লিস্ট যাচাই করলেও তো বিষয়টি সত্য কিনা, জানা যেত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা অফিসিয়ালি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আসিক সম্পূর্ণ নির্দোষ। ইয়াবা সেবন কিংবা ব্যবসা দুরে থাক, সে ধূমপানও করেন না।’

মিথ্যা অভিযোগে আসিককে জেলে পাঠানো হয়েছে দাবি করে পুলক ঘটক বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে প্রতিবাদ কর্মসূচি দেব।’

ওইদিন রাতে টহল পুলিশের দায়িত্বে থাকা ও মামলার বাদী পল্টন থানার এএসআই আশরাফ আলীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘তল্লাশি করে তার প্যান্টের ডান পকেট থেকে সাদা পলিথিনে মোড়ানো একটি প্যাকেটে ১০টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। আর টাকা চাওয়ার বিষয়টি মিথ্যা। তার কাছে কোনও টাকা চাওয়া হয়নি।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আসামিদের কাছ থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারের ঘটনা সত্য। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আর টাকা চাওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনও তথ্য নেই।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আসিককে যে ইয়াবাসহ ধরেছে, এটা সত্য। তিনি পুলিশের কাছে স্বীকারও করেছেন। আমি মনে করি আসিকের স্বজনরা মিথ্যা বলছেন। তারপরও যদি তার স্বজনরা লিখিতভাবে কোনও অভিযোগ দেয়, তাহলে আমরা তা তদন্ত করে দেখব।’ সৌজন্যে- বাংলা ট্রিবিউন।

ঢাকা জার্নাল, জুলাই ৮, ২০১৭।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.