বিদ্রোহের আগে খালেদাকে ৪৫ বার ফোন করেন তারেক

জানুয়ারি ১২, ২০১৬

12২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই ষড়যন্ত্রের মূলোত্পাটন করা হবে। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্রায়ই তাঁর ভাষণে দোষারোপ করেন, বিডিআর বিদ্রোহ নাকি আওয়ামী লীগই করেছে। আমরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করলাম। দুই মাসের মধ্যে সেই বিদ্রোহ হয়েছিল। নতুন সরকার কেন একটি বাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটাবে? এটা কোনো দিন কোনো সরকার করতে পারে না। খালেদা জিয়ার কাছে আমার প্রশ্ন, বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হলো সকাল ৯টার দিকে। খালেদা জিয়া তখন ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে থাকতেন। তিনি কেন ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা-৮টার সময় বেরিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেন? এর জবাব তাঁকে জনগণের কাছে দিতে হবে। তাঁর যোগসূত্র ছিল।’ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন।

দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিডিআর বিদ্রোহের আগে তারেক রহমান লন্ডন থেকে খালেদাকে ৪৫ বার ফোন করেছিলেন বলে গতকাল সমাবেশে দাবি করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি বলেন, ‘তাঁর পুত্র লন্ডন সময় রাত ১-২টার (বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা-৮টা) মধ্যে ৪৫ বার তাঁকে ফোন করে। তাঁকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে। কেন বলেছে? তাঁরও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।’ এই ষড়যন্ত্রের মূলোত্পাটন একদিন হবে বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপিকেও অবৈধ বলে গণ্য করা দরকার : জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণ অবৈধ-অসাংবিধানিক। হাইকোর্ট সেই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। সেই রায়ের মধ্য দিয়ে জিয়ার ক্ষমতা দখল অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। কাজেই তিনি যা যা করে গেছেন তা সব অবৈধ। ক্ষমতায় গিয়ে জিয়াউর রহমান যে দল গঠন করেছেন, সেটাও প্রকৃতপক্ষে অবৈধ বলে গণ্য করা দরকার। জিয়াকে আর রাষ্ট্রপতি বলা যাবে না। কারণ হাইকোর্টের রায় তাহলে মানা হবে না।’ পাকিস্তান যে সুরে কথা বলে, উনি সেই সুরে কথা বলেন : মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার কটাক্ষের জন্য তাঁর সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয় মনে হয় খালেদা জিয়া ভুলতে পারেন না। কারণ তাঁর দিলমে হ্যায় পেয়ারে পাকিস্তান। পাকিস্তান যে সুরে কথা বলে, উনি সেই সুরে কথা বলেন।’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রো রেলবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাধা তৈরি না করতে আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। বাধা দিয়ে সরকারের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ক্লাস নেওয়া বন্ধ করলে ছাত্রছাত্রীরাও তা মেনে নেবে না : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষকদের আমি বলব, ১২৩ ভাগ বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি। যদি কোনো অসুবিধা আপনাদের হয় সেটা তো আমরা দেখব, আমরা দেখছি। তাই বলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আপনারা নষ্ট করবেন না। ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা যদি আপনারা বন্ধ করেন, ছাত্রছাত্রীরাও তা মেনে নেবে না। আমরা সরকারে আসার পর থেকে যেমন যানজটমুক্ত রাস্তাঘাট তেমনি সেশনজটমুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে, আমরা তাই চাই।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘শিক্ষকদের সম্মান অনেক ওপরে। এখন একজন শিক্ষক যদি সচিবের সমান মর্যাদা চান তবে আমার আর কিছু বলার নেই। আমার শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান সাহেব, আমার শিক্ষক রফিক স্যার, প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁদের আমি সম্মান করি। তাঁরা প্রফেসর হিসেবেই সেই সম্মান পান। কাজেই সম্মানবোধটা কিছুটা নিজের ওপর নির্ভর করে।

ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে ওই সম্মান আদায় করার কথা বলা এটা একজন শিক্ষককে মানায় না। এটা একজন শিক্ষকের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। কাজেই সমস্যাটা কী সেটা তো আমরা আলোচনা করছিই, দেখছিই। যার যার কর্মক্ষেত্র তার তার এখানে। আর যদি সচিবের মর্যাদাই লাগে তবে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা সচিব হয়ে যান বা পিএসসিতে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেন। তাহলে তো আর কোনো সমস্যা থাকে না।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘শিক্ষকদের চাকরির বয়স? একজন সচিব ৫৯ বছর পর্যন্ত চাকরি করেন। আর আমি নিজে শিক্ষকদের চাকরির বয়স ৬৫ বছর করে দিয়েছি, তাঁদের দাবিও করতে হয়নি। কাজেই ওনারা কি চান ওনাদের চাকরির বয়স সরকারি চাকরির মতো ৫৯ বছরে নেমে আসুক! সেটা তো না। ওনারা তো ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করবেন, বেতন-ভাতা পাবেন। কাজেই তুলনা করলে তো অনেক কথাই বের হয়ে আসে। আমি সেটা করতে চাই না। কারণ শিক্ষকরা তাঁদের মর্যাদা নিয়ে থাকুন, সম্মান নিয়ে থাকুন সেটাই আমরা চাই। সমস্যা হলে সেটা আমরা দেখব।’ যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রো রেল রুট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তিতে এই মেট্রো রেল করা হয়। এই রেল আকাশপথে যাবে, নিচ দিয়ে যাবে না। আর যেখানে যেখানে সাউন্ডপ্রুভ করা দরকার সেখানে সেখানে তা করে দেওয়া হবে। কাজেই সেভাবেই এটার ব্যবস্থা হবে। এখন আমার প্রশ্ন, আমি দেখলাম হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র-শিক্ষক নেমে গেছে মেট্রো রেল এখান দিয়ে যাবে কেন? গ্রামবাংলায় একটা কথা আছে না, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! যাদের জন্য মেট্রো রেল করলাম, যেই ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী, এখানে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, বাংলা একাডেমিসহ প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান সকলে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। যানজটমুক্তভাবে চলাচল অল্প সময়ের মধ্যে। সেখানে হঠাৎ এই আন্দোলন কিসের জন্য?’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা হয় সেই সময় এই ফুলবাড়িয়াতে এই রেলস্টেশন ছিল। ওসমানী উদ্যানের পাশে যে রেলভবন সেটাই ছিল রেলস্টেশন।

সেখান থেকে এস এম হল, এফ এইচ হল, এখনকার জহুরুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, পলাশী, এলিফ্যান্ট রোড হয়ে হাতিরপুল যেত। কাজেই রেলস্টেশনের পাশেই কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যাতে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী ওই রেলগাড়িতে করে আসা-যাওয়া করতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে রেললাইন আছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রেললাইন আছে। রেললাইন পৃথিবীর কোথায় নাই? হঠাৎ এটা নিয়ে এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে, আমি তো এর কারণ খুঁজে পাই না। কাদের স্বার্থে আমরা করেছি? যানজটে আটকা পড়ে থাকবে নাকি মেট্রো রেলে সাঁইসাঁই করে ক্লাস করবে, বাড়ি ফিরে যাবে? কার সুবিধা বেশি? সুবিধা তো শিক্ষার্থীদেরও, সেটা তো বুঝতে হবে। এখানে এক শ্রেণির লোক আছে, যা-ই করতে যাই সেখানে একটা কিন্তু খুঁজে আন্দোলন শুরু করে।’ আশরাফ বললেন, শেখ হাসিনাকে কয়েক টার্ম সময় দিতে হবে : সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আরো সময় দিতে হবে। এক টার্ম (মেয়াদ) নয়, কয়েক টার্ম সময় দিতে হবে। তাঁর নিজের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্য এ সময় দিতে হবে।’ ১০ তারিখের সমাবেশ পিছিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি তুলে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘বিশ্ব ইজতেমার কারণে আমরা সমাবেশ এক দিন পিছিয়ে দিয়েছি। কিন্তু খালেদা জিয়া গত বছর তাঁর অবরোধ তুলে নেন নাই। তারপরও তাঁদের কাছে শেখ হাসিনা মুসলমান নন। মুসলমান হতে হলে আর কতবার শেখ হাসিনাকে হজে যেতে হবে, নামাজ পড়তে হবে? এটাই হলো বাংলাদেশের দুঃখজনক অধ্যায়।’ দুপুর আড়াইটায় শুরু হওয়া এ সমাবেশে আরো বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, ফজলুল করিম সেলিম ও মোহাম্মদ নাসিম, কেন্দ্রীয় নেতা আহমদ হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, আমিনুল ইসলাম আমিন প্রমুখ। কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে সমাবেশে সমাপনী বক্তব্য শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বক্তব্য দেন তিনি। সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২১ বছর (১৯৭৫-৯৬) এ দেশের মানুষ বঞ্চিত ছিল। আর তারপরে ওই সাত বছর (২০০১-০৮)—মোট ২৯ বছর।

আওয়ামী লীগ আসার পর থেকে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের যেমন আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, উন্নতি হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এভাবেই আমরা আমাদের দেশের উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪-এর নির্বাচনে জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে বলে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে। আজকে বাংলাদেশ বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে নিম্ন মধ্যম আয়ের। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশকে উন্নীত করব। এবং আমরা তা করতে পারব, সেই বিশ্বাস আমার আছে। অত জ্বালাও-পোড়াও, অত বাধাটাধা দিয়ে আমাদের এই অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না—এটা আমার বিশ্বাস।’ সমাবেশের নির্ধারিত সময় দুপুর আড়াইটার আগে থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিছিল, শোভাযাত্রা নিয়ে নেতাকর্মীরা উপস্থিত হতে শুরু করে। ঢাকার আশপাশের জেলার নেতাকর্মীরাও মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নেতৃত্বে হাতি, ঘোড়ার গাড়ি, রং-বেরঙের পতাকা, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বর্ণাঢ্য মিছিলসহ সহস্রাধিক নেতাকর্মী সমাবেশে আসে। নির্ধারিত সময়েই সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশ পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। আজ জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রধানমন্ত্রীর আজ ১২ জানুয়ারি। দুই বছর আগে এই দিনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও স্টেশনগুলো একযোগে এই ভাষণ সম্প্রচার করবে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.