ওরা বেইমানী করে না

ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫

এস এম আববাস : মধ্যরাতে বাতাস বইছে উত্তরের। কনকনে শিতে একপা দু’পা করে সামনে এগুতেই সন্ধান পাওয়া গেল সেই ‘পাগলের’। টোকাই আর দিনমজুরদের কাতারেই ফুটপথে শুয়ে আছেন রহস্যময় সেই মানুষটি।

Sadikur-151226-03

প্রতিরাতেই তিনটে কুকুরের সঙ্গে যার ফুটপথেই রাত্রিবাস। বছরের পর বছর এভাবেই কাটছে তার। যদিও দিনের বেলায় তার দেখা পাওয়া যায় না।

রাতে সন্ধান পাওয়ার পর তাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হলো। অনেক চেষ্টায় বেরিয়ে এলো অজানা অনেক কথা। যেটুকু শুনে তাঁর সন্ধান করা, পাওয়া গেল তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই আবিষ্কারের আনন্দটাও ভিন্ন রকম।

লোকে পাগল বললেও আসলে তিনি পাগল নন।

রাজধানীর ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজার যেতে প্রথম ফুটওভার ব্রিজ। তার আগেই ফার্মগেট থেকে বাম পাশে (পুর্ব পাশ) ফুটপথে হাঁটতেই একটি যাত্রীছাওনী। পরিত্যক্ত যাত্রীছাওনি বলাটাই মানানসই।

Sadikur-151226-07শুক্রবার (২৫ ডিসেম্বর) দিনগত মধ্যরাতে (২৬ ডিসেম্বর  শনিবার) কম্বলের মধ্যে যেনো নিচে শুয়ে আছেন সেনাবাহিনীর নায়েক সাদিকুর।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অজ্ঞাত এক লোকের কাছে আবার জানতে চাওয়া এই কম্বলের নিচে যিনি শুয়ে আছেন, তিনিই কি কুকুর নিয়ে শুয়ে থাকেন। অজ্ঞাত এই লোকটি তা নিশ্চিত করেন।

কম্বলের ভেতর থেকে বের করা গেলো সন্ধান করা লোকটিকে অজ্ঞাত ওই  ব্যক্তির সহায়তায়। সঙ্গে টমি ও হিটলারসহ তিনটি কুকুর। নিজে কম্বলের ভেতর থেকে বেরুনোর পর কুকুর তিনটিও বেরিয়ে পড়ে কম্বলের নিচ থেকে। যদিও বার বার তাদের কম্বলের নিচে রাখার চেষ্টা করছেন সাদিকুর।

সাদিকুর জানান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন তিনি। আর দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮১ সালে নায়েব হিসেবে অবসরে যান। পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে কর্মরত থাকলেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।

Sadikur-151226-09এসব কথা জানানোর এক পর্যায়ে বেশ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে উঠেন। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে দুই ভাষাতেই তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ছিলাম ন্যাশনাল টাইগার অব পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশে ন্যাশনাল টাইগার হতে পারিনি। তাই এখন ডাস্টবিনে। দ্রুতগতিতে কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুর।

এবার উল্টো জানতে চান এসব বলে আমার লাভ কি? আমার কথাগুলো কি শেখ হাসিনার কানে যাবে? তোমরা লিখলেই কি বঙ্গবন্ধুর  কন্যা শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছুবে?

বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সহসায় আবার আলাপচারিতা শুরু করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, বাড়ি বরিশালের মেহেন্দেীগঞ্জের শ্রীপুর এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৫ নম্বর সেক্টরে ছিলাম। কমান্ডার ছিলেন মীর শওকত।

পঞ্চগড়ে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। চারজনকে মেরে ফেলে রেখে ওরা চলে যায়। কিন্তু আমি মরিনি। অন্য তিনজন মারা যান। ওরা (পাক সেনা) মরে গেছি ভেবে আমাদের ফেলে রেখে চলে যায়। চার  ঘণ্টা পর আমি বুঝলাম মরিনি বেঁচে আছি।

সরকার কোনো সহায়তা করছে কিনা জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুর বলেন, সরকার ৮ হাজার টাকা দেয়। তা দিয়ে ছেলেকে ইন্টার মিডিয়েট পড়াচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার কথা পৌঁছে দিলে তাকে আর ফুটপথে থাকতে হবে না। বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনা জানলে আমার একটা ঘর হবে।

Sadikur-151226-10মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া ভাতা আর পেনশনের অর্থ দিয়ে কোনো রকমে চলে যায়। তাহলে টোকাই আর দিন মজুরের কাতারে ফুটপথে কুকুরের সঙ্গে রাত্রিবাস কোনো জানতে চাইলে বলেন- ওরা আমার সঙ্গে বেইমানী করেনা। আমি আগেও বিড়াল পালন করেছি। কাক পাখিদের খাওয়েছি। কেউ বেইমানি করেনি।

কথা বলতে বলতেই হঠাৎ আবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এই মুক্তিযোদ্ধা। নিজেকে আওয়ামী লীগের একনিষ্ট লোক দাবি করেন। ভদ্রভাষায় গালাগালিও করেন কয়েকজন বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতার নাম ধরে। বলেন- ওরা আওয়ামী লীগকে ভালবাসে না। শুধু স্বার্থ খোঁজে। দেশের মানুষ খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে দেশের উন্নতি করছেন। আর ওরা শুধু টাকা কামিয়ে যাচ্ছেন।

ঘর-সংসার আর আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহ দেখাননি এই মুক্তিযোদ্ধা। দিনে কুকুরগুলো নিয়ে কোথায় রাখেন, নিজে দিনের বেলায় কোথায় থাকেন তাও জানাতে চাননা। শুধু বলেন আমি পীরের মুরিদ।

ততক্ষণে ঠাণ্ডা বাতাসে তার কথাগুলো আস্তে আস্তে জড়িয়ে গেছে। পীরের নামকি বললেও তা বুঝে নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই মুক্তিযোদ্ধার কষ্টের সবগুলো কথা জানার চেষ্টা থাকলেও রহস্যই থেকে যায় বেশ খাণিকটা।

লেখক- এস এম আববাস, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজ২৪.কম

ঢাকা জার্নাল, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.