বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে মুগ্ধ এক জাপানি পরিচালক

ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫

04নাগিসা ওশিমা। বিখ্যাত নির্মাতা আকিরা কুরোশাওয়ার সমসাময়িক জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক তিনি। অবশ্য ধ্যান-ধারণার দিক দিয়ে কুরোশাওয়ার বিপরীত পথের অনুগামী ছিলেন। জাপানের প্রথা-ঐতিহ্যের নানা অসঙ্গতি আর নানা ভুল রাজনৈতিক প্রবণতাই ছিল তার সিনেমাগুলোর বক্তব্য। জাপানের রাজনীতি নিয়ে তো বটেই, জাপানের আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে, এমনকি প্রাচীন জাপানের বিকৃত যৌনপ্রথা নিয়েও সিনেমা বানিয়েছেন তিনি। এত সব কাজের ভীড়ে অবশ্য টেলিভিশনের জন্য বানানো তার ছোট-বড় ডকুমেন্টারিগুলো নিয়ে কথা বলার ফুরসতই মেলে না। কিন্তু তার সেই টিভি-ডকুগুলোর কয়েকটির জন্যই তাকে আমাদের মনে রাখতে হবে। কারণ, সেগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ও সে বিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত।

নাগিসা ওশিমার জন্ম ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ, জাপানের শুগোকু রিজিওনের ওকায়ামা প্রদেশের তামানো শহরে। বিখ্যাত কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন পলিটিক্যাল হিস্ট্রি নিয়ে। পড়া শেষ করে অবশ্য পলিটিক্যাল হিস্ট্রির সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো পেশায় জড়াননি তিনি। বের হয়েই যুক্ত হন সোচিকু লিমিটেড নামের এক ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানির সঙ্গে, পরিচালক হিসেবে। বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এই পেশাতেই, সিনেমার সাথেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা তার কোনো কাজে আসেনি, তা ভাবারও কোনো কারণ নেই। পলিটিক্যাল হিস্ট্রির ছাত্র ছিলেন বলেই তো তার সব সিনেমাতেই এক ধরনের রাজনৈতিক চেতনার স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়। সে কারণেই তো এশিয়ার নব্য স্বাধীনতা-প্রাপ্ত বাংলাদেশ তাকে আকর্ষণ করেছিল। বিশেষ করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন, তাও আবার মাত্র ৯ মাসের মধ্যে, তাকে আকর্ষণ করেছিল। আর আকর্ষণ করেছিল দেশটির নেতার বিশাল সাহসী ব্যক্তিত্ব। তাই একটি-দুটি নয়, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে তিনি বানিয়েছেন চার-চারটি ডকুমেন্টারি।

পরিচালক নাগিসা ওশিমার এই রাজনৈতিক সচেতন সত্তা স্পষ্ট হয়ে যায় তার প্রথম দিকের সিনেমাগুলোতেই। বিশেষ করে তার পঞ্চম সিনেমা নাইট অ্যান্ড ফগ ইন জাপান (১৯৬০)-এ। সিনেমাটি মুক্তির আগ দিয়ে জাপানের সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা ইনেজিরো আসানুমা খুন হন। প্রতিক্রিয়ায় সিনেমাটির প্রযোজনা সংস্থা সোচিকু লিমিটেড নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে সিনেমাটি নামিয়ে নেয়। আর তার প্রতিক্রিয়ায় সোচিকু ছেড়ে দেন নাগিসা ওশিমা। সিনেমাটি অবশ্য কিনেমা জুম্পো বা কিনেজুন পত্রিকার বছরের সেরা দশ সিনেমার তালিকায় জায়গা করে নেয়। এই তালিকাটিকে তারও আগে থেকেই জাপানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সিনেমার তালিকা হিসেবে ধরা হয়। পরে সিনেমাটির জন্য জিতে নেন ব্লু রিবন পুরস্কার। একই পুরস্কার পান সেই বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রুয়েল স্টোরি অব ইয়ুথ (১৯৬০) সিনেমার জন্যও। সে বছরই তিনি ডিরেক্টরস গিল্ড অব জাপানের উদীয়মান পরিচালকের পুরস্কার জিতে নেন।

পরের বছর মুক্তি পায় ওশিমার পরের সিনেমা দ্য ক্যাচ (১৯৬১)। এটা যাকে বলে পুরোপুরি রাজনৈতিক সিনেমা। যুদ্ধের সময়ে এক জাপানি গ্রামে ধরা পরা এক আফ্রো-আমেরিকান যুদ্ধবন্দির গল্প। সিনেমাটি ওশিমার সেরা কাজ হিসেবে ধরা হয় না বটে, কিন্তু কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সিনেমাতেই ওশিমার সামনের সিনেমাগুলোর মূল প্রবণতাগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা দিতে শুরু করে। বিশেষ করে ধর্মান্ধতা ও বিদেশিদের সম্পর্কে অহেতুক ভয়। বিশেষ করে এই প্রবণতাগুলোর পরিণত রূপ দেখা যায় ডায়েরি অব ইউনবোগি (১৯৬৫), ডেথ বাই হ্যাঙ্গিং (১৯৬৮) এবং থ্রি রিসারেক্টেড ড্রাংকার্ডস (১৯৬৮) সিনেমাগুলোতে।

ওশিমার ১৯৬৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ডেথ বাই হ্যাঙ্গিং আরেকটি কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৮ সালের কোরিয়ার এক ধর্ষণ ও হত্যার কাহিনি নিয়ে সিনেমাটি বানান তিনি। একে তো তার কোরিয়া ঘুরে আসার স্মৃতি বহন করছে সিনেমাটির কাহিনি। তার উপর তিনি সিনেমাটিতে ব্রেখট-গঁদারের কিছু কৌশল ও ধরণ ব্যবহার করেন। তবে শেষ পর্যন্ত সিনেমাটিতে বড় হয়ে দেখা দেয় কোরিয়ানদের প্রতি জাপানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে এক ধরনের রাজনৈতিক বিদ্রূপের কারণে। এর চিত্রনাট্যের জন্য তিনি ‘কিনেমা জুম্পো’ অ্যাওয়ার্ড পান।

১৯৭১ সালে ওশিমা বানান দ্য সেরেমনি সিনেমাটি। পরের বছর কম-গুরুত্বপূর্ণ ডিয়ার সামার সিস্টার। প্রথমটির জন্য তিনটি শাখায় ‘কিনেমা জুম্পো’ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। আর ১৯৭৬ সালে বানান ইন দ্য রেল্ম অব দ্য সেন্সেস। মাঝের সময়টাতে টিভি-ডকু ছাড়া আর কিছুই বানাননি তিনি। হ্যাঁ, এই সময়ে বানানো তার ১০টি টিভি-ডকুর চারটিই আমাদের নিয়ে, আমাদের দেশ আর আমাদের জাতির পিতাকে নিয়ে।

১৯৭২ সালে প্রচারিত হয় বাংলাদেশ নিয়ে বানানো নাগিসা ওশিমার প্রথম ডকুমেন্টারি ‘জয়! বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধের অমিত শক্তিশালী এই শ্লোগানটি লেখার সময় জয়-এর শেষে একটা বিস্ময়সূচক চিহ্ন লাগিয়ে তিনি যেন শ্লোগান দেয়ার ঢংটিও নামে নিয়ে এসেছেন।

পরের বছর প্রচারিত হয় নাগিসা ওশিমার আরো দুটি টিভি-ডকু; একটি বাংলাদেশকে নিয়ে, নাম ‘বাংলাদেশ স্টোরি’। আরেকটি বাংলাদেশের জাতির জনককে নিয়ে, নাম ‘রহমান: ফাদার অব বেঙ্গল’। সুনির্মিত এই ডকুমেন্টারিটির শেষ কথাগুলোও অনেকটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই ফলে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের ভবিষ্যত এবং তিনি যে জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে জাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু বলা সত্যিই বেশ দুরূহ। তবে একটি কথা খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা যে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে একত্রে বাস করতে চান, তা সহসাই পূরণ হওয়ার নয়। কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের জন্য, শুধুই বাংলাদেশের জন্য।

মাঝে কয়েক বছর বিরতি দিয়ে ১৯৭৬ সালে আবারো বাংলাদেশ নিয়ে বানানো তার টিভি ডকু ‘দ্য গোল্ডেন ল্যান্ড অব বেঙ্গল’ প্রচারিত হয়। ততদিনে অবশ্য সোনার দেশে অন্ধকার নেমে এসেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক অরাজক সময়ে প্রবেশ করেছে। নাগিসা ওশিমাও এরপরে আর বাংলাদেশে আসেননি, বাংলাদেশ নিয়েও কোনো কাজ করেননি।

এরপরে আরো চারটি সিনেমা বানিয়েছেন নাগিসা ওশিমা। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া এম্পায়ার অব প্যাশন সিনেমার জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান। ১৯৮৩ সালে মেরি ক্রিসমাস, মিস্টার লরেন্স বানান যুদ্ধবন্দিদের জেলখানার কাহিনি নিয়ে। সিনেমাটির জন্য কিনেমা জুম্পো রিডার্স চয়েস পুরস্কারও পান। ১৯৮৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ম্যাক্স, মন আমোঁ সিনেমার কাহিনি লিখে দেন ফরাসি জ্যাঁ-ক্লদ ক্যারিয়ের। যিনি লুই বুনুয়েলের সঙ্গে কাজ করেছেন অনেক সিনেমাতেই।

এরই মধ্যে তিনি বেশ কয়েক দফায় ডিরেক্টরস গিল্ড অব জাপানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালে তার লেখা সিনেমা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোর সংকলন প্রকাশিত হয় সিনেমা, সেন্সরশিপ অ্যান্ড দ্য স্টেটস নামে।

১৯৯৬ সালে তিনি স্ট্রোক করেন। অবশ্য সে যাত্রায় ধাক্কা কাটিয়ে ওঠেন। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় সামুরাই কাহিনি নিয়ে বানানো সিনেমা ট্যাবু। সিনেমাটি সেরা সিনেমা ও সেরা পরিচালক শাখায় জিতে নেয় ব্লু রিবন পুরস্কার। ২০০০ সালে মার্কিন লেখক জন গ্রে-র বেশ কিছু লেখারও অনুবাদ করেন। সেগুলো প্রকাশিত হয় ৪ খণ্ডে।

এরপর তার শারীরিক অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়। তিনি সেসুই হায়াকাওয়া-কে নিয়ে একটা বায়োপিক বানানোর পরিকল্পনাও করেছিলেন। কিন্তু সে কাজে আর হাত দিতে পারেননি তিনি। অবশ্য অসুস্থ শরীর নিয়েও বেঁচে ছিলেন অনেকদিন। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যান বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চারটি সুনির্মিত ডকুমেন্টারি বানানো এই বিদেশি সুহৃদ পরিচালক।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.