দলীয় নির্বাচনে আরো উপেক্ষিত নারী

ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫

03রাজনৈতিক দল ও দলীয় প্রতীক সামনে রেখে এবারের পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক এ নির্বাচন দলগুলোর জন্য মর্যাদার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এবার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, নানা যোগ-বিয়োগে সে হিসাব এখন স্পষ্ট। আর নৌকা, ধানের শীষ ও লাঙলের ঠিক এই হিসাব-নিকাশের সামনে এসেই রীতিমতো ‘মার’ খেয়ে যাচ্ছে নারীরা। সভা-সেমিনারে নারীদের সক্ষমতা অর্জনের প্রচার যতই চালানো হোক না কেন বাস্তবে নারী-পুরুষের সমতা আসার ক্ষীণ কোনো লক্ষণও নেই। দেশের ২৩৪টি পৌরসভা নির্বাচনে মাত্র ১১ জন নারী প্রার্থীকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাতজন এবং বিএনপি মাত্র একজন নারীকে মেয়র পদে প্রার্থী করেছে। এ ছাড়া ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) মনোনয়ন দিয়েছে তিনকে। বাকি ১৭টি দলের প্রার্থীর তালিকায় কোনো নারী মেয়র প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এমনকি বাম দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও কোনো নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি। গত পৌর নির্বাচনের চিত্রও এর চেয়ে উজ্জ্বল ছিল। সেবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত ১৪ প্রার্থী মাঠে ছিলেন। বিএনপিও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। ১২ নারীকে সমর্থন দিয়েছিল তারা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এবার দলগুলোর আরেকটু সাহস দেখানোর কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা পিছিয়ে পড়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়েনি। জয়ের সম্ভাবনা, গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক দক্ষতার বিচারেও তারা পিছিয়ে। এর সঙ্গে নিরাপত্তার প্রসঙ্গটিও তুলেছে কেউ কেউ। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ২৩৩ জন। এর মধ্যে সাত নারী প্রার্থী হলেন পঞ্চগড় পৌরসভায় জাকিয়া খাতুন, ঠাকুরগাঁওয়ে তাহমিনা খাতুন, রাজশাহীর চারঘাটের নারগিস খাতুন, নাটোরের গোপালপুরে রোকসানা মোর্তুজা ও সিংড়ায় উমা চৌধুরী, সিরাজগঞ্জের বেলকুচির আশানুর বিশ্বাস এবং নারায়ণগঞ্জের তারাবতে হাসিনা গাজী, যা মোট মেয়র প্রার্থীর মাত্র ২.৯৯ শতাংশ।

রাজশাহীর চারঘাটের নারগিস খাতুন গতবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মেয়র নির্বাচিত হন। গতবার ২৫৪টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে জয়ী হওয়া তিনিই একমাত্র নারী প্রার্থী। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হয়। প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু, দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কেমন, নির্বাচনী এলাকায় দলের নেতাকর্মীদের এক করে মাঠে নামাতে পারবেন কি না, প্রার্থীর শিক্ষা ও রাজনৈতিক দক্ষতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়। বাস্তবতা হলো, এসব যোগ্যতার মাপকাঠিতে খুব বেশি নারী প্রার্থী পাওয়া যায়নি।’ লেনিন আরো বলেন, ‘আমরা লৈঙ্গিক সমতায় পৌঁছাতে চাই। আমরা চাই আরো বেশি নারী নেতৃত্ব উঠে আসুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ দেশে নারীদের শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি হলেও রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে না।

এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, ইউরোপ, আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতেও একই চিত্র।’ এ ক্ষেত্রে এবার বিএনপির অবস্থান আরো করুণ। মেয়র পদে বিএনপির একমাত্র নারী প্রার্থী হলেন শাহনাজ আক্তার। বিএনপির মোট মেয়র প্রার্থী সংখ্যা ২১৯। অর্থাৎ মোট মেয়র প্রার্থীর দশমিক ৪২ শতাংশ আসনে তাদের নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শাহনাজ আক্তার কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভায় মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁর স্বামী হুমায়ুন কবির পারভেজ পৌর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ‘নিখোঁজ’ আছেন। এই দৈন্যদশা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহাজাহান বলেন, ‘মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের দল থেকে নারী বা কোনো সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করা হয়নি। এবার একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন হচ্ছে না। বিএনপি কেবল গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য নির্বাচন করছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, নারী প্রার্থী কমেছে।

এটা হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি সেদিকে নিয়ে গেছে।’ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আরেকটি দল ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) তিনজন প্রার্থী রয়েছেন, যা তাদের মোট প্রার্থীর ১৭.৬৪ শতাংশ। তাঁরা হলেন নরসিংদী পৌরসভায় (এনপিপি) ফারজানা আক্তার, পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় রাবেয়া খাতুন এবং হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে একমাত্র নারী মেয়র পদপ্রার্থী হয়েছেন খালেদা বেগম। সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকে এবার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭৩ জন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতা হলেও পৌর নির্বাচনে তাঁদের কোনো নারী প্রার্থী নেই।  অথচ রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্তে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তাদের সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীকে রাখতেই হবে।

এই শর্ত মেনেই ২০০৮ সালে দলগুলো নিবন্ধন পায়। প্রায় সাত বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে কোনো দলের মেয়র পদে মনোনয়নে নারীরা ৩ শতাংশের বেশি মনোনয়ন পাননি। আর গড় হিসাবে মোট দলীয় মেয়র পদে নারীরা মনোনয়ন পেয়েছেন মাত্র ১ শতাংশেরও কম। নারীনেত্রী ও জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান বলেন, ‘এত কমসংখ্যক নারীর মনোনয়নে আমি খুবই মর্মাহত, কিন্তু আশ্চর্য হয়নি। নারী সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু নারী-পুরুষের সমতা আসেনি। দলগুলো এখনো নারীদের যোগ্য প্রার্থী মনে করে না। নির্বাচন কমিশনও এটা করছে না।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কথা ও কাজের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এটা ঠিক যে রাতারাতি সবকিছু পরিবর্তন হবে না। তবে পরিবর্তনের জন্য যা করা দরকার, সেটা তারা শুরু করছে না। সাধারণ কমিশনার পদ : মোট পদের সংখ্যা আট হাজার ৫৮৯টি।

এর মধ্যে মাত্র ৩২টি আসনে নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৭৩৩টি এবং এর বিপরীতে প্রার্থীর সংখ্যা দুই হাজার ৫৩৩ জন। নারী প্রার্থীতে এগিয়ে রাজশাহী : এই বিভাগের ৫২ পৌরসভার ২৫০ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে নারীর সংখ্যা ছয়জন। বিভাগওয়ারি হিসাবে এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যা। পঞ্চগড় পৌরসভায় জাকিয়া খাতুন, ঠাকুরগাঁওয়ে তাহমিনা খাতুন, রাজশাহীর চারঘাটের নারগিস খাতুন, নাটোরের গোপালপুরে রোকসানা মোর্তুজা ও সিংড়ায় উমা চৌধুরী, সিরাজগঞ্জের বেলকুচির আশানুর বিশ্বাস। নারীশূন্য চট্টগ্রাম : আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, বিভাগের সাত জেলার একটি পৌরসভায়ও রাজনৈতিক দলগুলো মেয়র পদে কোনো নারী প্রার্থী দেয়নি। শুধু তাই নয়, সাধারণ ওয়ার্ডগুলোতেও কাউন্সিলর পদে বলতে গেলে অনেকটা নারী প্রার্থী শূন্য। দু-একটিতে প্রার্থী থাকলেও বেশির ভাগ ওয়ার্ডে নারী প্রার্থী নেই। নারী প্রার্থীরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত সংরক্ষিত ওয়ার্ডেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সেখানেও তুলনামূলক কম প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন চট্টগ্রাম জেলায় ১০টি পৌরসভা।

এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলায় তিনটি, ফেনীতে তিনটি, রাঙামাটিতে একটি, বান্দরবানে দুটি, খাগড়াছড়িতে দুটি ও নোয়াখালীতে চারটি পৌরসভায় নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু এ ২৫টি পৌরসভায় মেয়র পদে একজন নারীকেও রাজনৈতিক দলগুলো দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়নি। এর বাইরে পৌরসভাগুলোর আওতাধীন সাধারণ ওয়ার্ডগুলোতেও নারী প্রার্থী অনেকটা নেই বললেই চলে। সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে জামায়াত সমর্থিত খালেদা আকতার, খাগড়াছড়ির সদর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে অন্তরা চাকমা নির্বাচন করছেন কাউন্সিলর পদে। এ দুটি ওয়ার্ড ছাড়া অন্য কোনো সাধারণ ওয়ার্ডে নারী প্রার্থী নেই। রাঙামাটির সদর পৌরসভায় সংরক্ষিত তিনটি ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাতজন মহিলা প্রার্থী। মেয়র ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে নারী প্রার্থী না থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটা এখন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে পুরুষ প্রার্থীরাই নির্যাতিত হচ্ছেন, সেখানে নারীরা কিভাবে অংশ নেবেন? আমরা সিটি নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর পদে নারী প্রার্থী দিয়েছিলাম। এখন সে পরিস্থিতি না থাকায় নারীরা প্রার্থী হতে চাচ্ছেন না।’ চট্টগ্রামের মানবাধিকার ও নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.