নীতিমালা নয় রাজনীতিতে আটকে গেছে কওমির স্বীকৃতি

ডিসেম্বর ১২, ২০১৫

38ঢাকা : দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় শিক্ষাঙ্গন কওমি মাদরাসা। প্রতি বছর পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বের হচ্ছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। কিন্তু এরপর এরা করছে কী? সরকারি স্বীকৃতি নেই সুতরাং সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নেই চাকরির সুযোগ। বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো যথেষ্ট পুঁজিও নেই। মসজিদ, মাদরাসাই এদের একমাত্র কর্মক্ষেত্র। কেউ কেউ প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোটখাটো কাজ করেন। এতে দীর্ঘ শিক্ষাজীবনের ১৬ আনাই বৃথা হয়ে যায়। বেকার সমস্যায় বড় অবদান রাখে এরা। শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করা বিপুল সংখ্যক ছেলে-মেয়ের এ পরিস্থিতির জন্য সরকারের অবহেলা ও সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে। এছাড়া এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্নও গুরুতরভাবে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

সম্পূর্ণ বিনামূল্যে থাকা-খাওয়াসহ পড়াশোনার যাবতীয় সরঞ্জাম পাওয়া যায় বলে কওমি মাদরাসাগুলোতে ৯০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী সমাজের নিম্নবিত্ত, এতিম, আর্থিকভাবে অসচ্ছ্ল পরিবারের সন্তান। মূলত জনসাধারণ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা কিছু বিদেশি অনুদানের টাকায় চলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

প্রায় ২শ বছরের পুরনো সিলেবাসে চলে পাঠদান। উর্দু, আরবি, ফারসি সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়। তবে ধর্মীয় বিষয়গুলোতেই বেশি গুরুত্ব পায়। এ বিষয়গুলো উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষায় রচিত। তবে পাঠদানে বাংলা ভাষাকেই প্রধান মাধ্যম ধরা হয়।

কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাকের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ৫ হাজার ৪৩৪টি। তালিকা বহির্ভূত আরো প্রায় সাড়ে ৩ হাজার রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৯ হাজার কওমি মাদরাসায় অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী সাড়ে ৩ লাখের মতো। প্রতিবছর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করছে।

তাদের কর্মক্ষেত্র বলতে মসজিদ, মাদরাসা। কয়েকটি দূতাবাসে অনুবাদকের কাজ (আরবি, উর্দু, ফরাসি ভাষাভাষী দূতাবাস)।
বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ কম্পিউটার, মোবাইল সার্ভিসিংয়ে সংক্ষিপ্ত কোর্স করে মোবাইল-কম্পিউটার মেরামত; অনুবাদ ও কম্পোজের কাজ করছে। কিছু শিক্ষার্থী ছোটোখাটো মুদিদোকান বা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। গুটিকয়েক সামর্থ্যবান শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তারপরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বেকারই থেকে যাচ্ছে। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এই বেকার যুবকদের খুব সহজেই জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের অবহেলাকেই দায়ী করেন কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সহকারি মহাসচিব মাওলানা আবুল ফাতাহ মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারের স্বীকৃতি নেই। নেই কর্মক্ষেত্রের সুবিধা। সরকারের অবহেলার কারণে এমন পরিস্থিতি বিরাজমান।’

সরকার কেন অবহেলা করছে? এমন প্রশ্নে ইয়াহিয়া বলেন, ‘মুঘল আমলে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে আলেমরা। ইংরেজ শাসনামল থেকে শুরু হলো কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের নীলনকশা প্রণয়নের কাজ। আজও সরকার সেই ব্রিটিশ কারিকুলামে বন্দি। আসলে পশ্চিমা ইশারায় সরকার কওমি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার পথে হাঁটছে।’

কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের ব্যাপারে সরকারের যে কোনো প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

মাওলানা ইয়াহিয়া মনে করেন, কওমি শিক্ষার্থীদের সরকারের স্বীকৃতি ও সর্বত্র কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়া হলে ‘প্রকৃত দ্বীনি শিক্ষা’ ঠিক রেখে অবশ্যই রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব।

তিনি হতাশার সুরে বলেন, কোরআন, হাদীস, আরবি, উর্দু, ফারসি, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয় যেসব  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কওমি শিক্ষার্থীদের সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ দিতে সরকারকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

অভিযোগ এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা  বলেন, ‘কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেয়া না দেয়ার বিষয়টি বর্তমানে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটি বিষয়। সরকারি ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়হীনতার কারণে কওমি কর্তৃপক্ষকে কোনো ধরনের প্রস্তাব দেয়া বা বিষয়টি সুরাহা করা যাচ্ছে না।’

কওমির স্বীকৃতির সঙ্গে এই রাজনীতির যোগটা তৈরি হয়েছে মূলত জোটভিত্তিক রাজনীতির চর্চা শুরু হওয়ার পর। বিশেষ করে ২০১৩ সালে কওমি মাদরাসা কেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থানের পর পুরোটাই রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই সংগঠনটি মূলত সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রচালিত হয়েছিল এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সে সুযোগও নেয়ার চেষ্টা করেছিল। এই সংগঠনে অনেক ধর্মভিত্তিক দলের নেতারাও আছেন। অর্থাৎ ধর্মীয় সংগঠনটি বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।

রাজনীতির কারণেই হয়তো এখানে কর্মকর্তাদেরও গা ছাড়া ভাব রয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, সরকারের একটি পক্ষ ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি বিবেচনা করে স্বীকৃতির পক্ষে মত দিলেও বাকিরা ‘চলছে চলুক’ মনোভাব পোষণ করেন। যদিও একসময় কওমি নেতাদের মধ্যেই স্বীকৃতি নিয়ে মতবিরোধ ছিল। কিন্তু এখন সে বিরোধ নেই বললেই চলে। বেফাকের সঙ্গে জড়িত আলেমরা সবাই-ই স্বীকৃতি চান।

তবে কওমি কর্তৃপক্ষ স্বীকৃতি চাচ্ছে না বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ‘তারা সরকারি স্বীকৃতি চায় না। স্বীকৃতি না চাইলে তো আর দেয়া যায় না। স্বীকৃতির জন্য চাওয়া লাগবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য অবসরে যাওয়া শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান (মন্তব্য নেয়ার সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন)  বলেন, ‘আমি কয়েক দিনের মধ্যে অবসরে যাচ্ছি। এ মুহূর্তে এসব বলে ঝামেলা বাড়াতে চাচ্ছি না।’

এদিকে কওমি কর্তৃপক্ষের গোঁড়ামীকে স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণ হিসেবে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী। তিনি  বলেন, ‘সরকার কওমি মাদরাসাকে কীভাবে স্বীকৃতি দিবে? তারা তো কোনো কিছু প্রকাশ করছে না। কী পড়াচ্ছে, এগুলো তো জানাতে হবে। স্বীকৃতি পেতে চাইলে অবশ্যই সরকারের সঙ্গে এসব বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ করা জরুরি বলে আমি মনে করি।’

তবে কওমি মাদরাসকে নিয়ন্ত্রণ নয় বরং নীতিমালার আওতায় আনার ওপর জোর দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘নানা দেশে নানান মাধ্যমের পড়াশোনা প্রচলিত। মাধ্যমের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী পড়াচ্ছে তার নীতিমালা। প্রতিটি মাধ্যমের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার। এ ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসাকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসাটা জরুরি।’

তিনি আরো বলেন, ‘নীতিমালা ছাড়া তো জানা যাবে না কী পড়ানো হচ্ছে। আমাদের সন্তানরা কী পড়ছে? তারা বিপদজ্জনক কিছু শিখছে না তো? এ বিষয়টা পরিষ্কার থাকতে হবে। এর জন্য নীতিমালার বিকল্প নেই।’

কওমি মাদরাসাকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসাকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকেও এ বিষয়ে আরো আন্তরিক হতে হবে।’

এদিকে স্বীকৃতির আগে কওমি মাদরাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপশি আধুনিক শিক্ষা দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ১কওমি মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা গরীব ঘরের। তারা শুরু থেকে বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনার এ বলয় থেকে তাদের বের করতে হলে; অবশ্যই আধুনিক শিক্ষার বিকল্প নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘যারা এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন তাদের উচিৎ আধুনিক শিক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখা। গরীবের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা না দিলে তারা কঠিন প্রতিযোগিতায় অংশই নিতে পারবে না। এবং হচ্ছেও তাই।’

আধুনিক বা জাগতিক শিক্ষা না থাকলে বঞ্চনার শিকল কোনো দিনই খোলা সম্ভব না- যোগ করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম।

এদিকে নীতিমালার বিষয়ে উল্টো অভিযোগ করেছেন কওমি শিক্ষার্থীরা। সরকারের প্রতি অভিযোগ করে তারা বলেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা নীতিমালার আওতার বাইরে। তারা কেন স্বীকৃতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে?

তাদের আরো অভিযোগ, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেখানে বাংলা ভাষাটা ভালো করে বলতে পারে না; সে ক্ষেত্রে তাদেরকে সব সুবিধা দেয়ার একটাই কারণ পশ্চিমা সিল!

এ নিয়ে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা আহমদ শফীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি অসুস্থতার কারণে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি নিয়ে জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে একাধিকবার যোগোযোগ করা হলে তারা কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

প্রসঙ্গত, দরসে নেজামী (দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষা পদ্ধতি) ও মাদানি নেসাব (মদীনা বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষা পদ্ধতি) নামে দুটি কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা এ দেশে প্রচলিত। তবে ৯৯ শতাংশ কওমি মাদরসাই দরসে নেজামী অনুসরণ করছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.