দারিয়ুস মেহেরজুঁই: ইরানি ছবির অগ্রপথিক

ডিসেম্বর ৯, ২০১৫

17ঢাকা: বিশ্বের এমন কোনো প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব নেই যেখানে এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না ইরানি চলচ্চিত্রের প্রভাব। অথচ সত্তর দশকের আগে ইরানি চলচ্চিত্র আজকের এই অবস্থানে ছিল না। ইরানি চলচ্চিত্রের মোড় যারা ঘুরিয়ে দিয়েছেন, যে পথে আজ ইরানি চলচ্চিত্রের চাকা ঘুরে চলেছে প্রতিনিয়ত, রঙ ছড়াচ্ছে পুরো বিশ্বের তাবৎ সব চলচ্চিত্র উৎসবে, বিশ্বের বাঘা বাঘা নির্মাতা, অভিনেতা, আর সিনেমাটোগ্রাফারদের সাথে টেক্কা দিয়ে ছিনিয়ে আনছে সেরা’র পুরস্কার সেই পথ নির্মাণ করে মানুষদের একজন দারিয়ুস মেহেরজুঁই।

পৃথিবীর সেরা সেরা নির্মাতাদের সাথে এখন উচ্চারণ হয় ইরানিয়ান নির্মাতাদের নাম। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব মানেই ইরানি ছবির ফুলঝুরি। অথচ একটা সময় ইরানি ছবি মানে উপমহাদেশীয় ছবির থেকেও নিম্নমানের হত। কিন্তু মহসিন মাখমাল্বফ, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, দারিয়ুস মেহেরজুঁইয়ের মত কিছু অসাধারণ নির্মাতাদের ছোঁয়ায় বদলে গেল পুরো ইরানি সিনেমা।

বিখ্যাত ‘দ্য কাউ’ ছবির একটি দৃশ্য…

ইরানি সিনেমায় সত্তর দশকের শুরুতে ‘নিউ ওয়েব’ নামে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন দারিয়ুস মেহেরজুঁই। তার দ্বিতীয় ছবি গাব(কালার)-কে মনে করা হয় ‘নিউ ওয়েব’ আন্দোলনের পথিকৃৎ। এরপর মাসউদ কিমিয়া এবং নাসের তাকবে যোগ হলে এই আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে দ্রুত তরুণ নির্মাতাদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।

দারিয়ুস মেহেরজুঁই তার ছবি নিয়ে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্টে যান, যা ওই সময়ে আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি। তাছাড়া বেশীর ভাগ সময় তিনি দেশি-বিদেশি উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করে সিনেমা করতে বেশী আগ্রহী ছিলেন। সেটাও ইরানি নির্মাতাদের মধ্যে এর আগে খুব একটা লক্ষনীয় ছিলো না।

২০০৭ সালে নির্মিত  

১৯৩৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ইরানি চলচ্চিত্রের এই অগ্রপথিক তেহরানের এক মধ্যবিত্ত ঘরে। শুরতেই মিউজিক এবং চিত্রকলার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো দারিয়ুসের। এমনকি সেই আগ্রহ থেকে তিনি নিজে নিজে দুর্দান্ত সান্তুর ও পিয়ানো বাজানো শিখেন। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় সিনেমা দেখার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ। এই আগ্রহ থেকে সারাদিন সিনেমা দেখায় মত্ত থাকতেন তিনি, কিন্তু তার ভাল লাগতো আমেরিকান সিনেমা। ইংরেজি খুব একটা বুঝতেন না বলে ডাবিংয়ে দেখতেন। কিন্তু তার মনে হয় ডাবিংয়ে মূল সুরটা কেটে যায়, আর এই ভাবনা থেকেই সিনেমা দেখার জন্য ইংরেজি শেখা শুরু করেন দারিয়ুস। আর সেই সময়ই ইতালিয়ান নির্মাতা ভিত্তুরি দ্য সিকার ছবি ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ দেখে প্রবল আলোড়িত হন তিনি। মাথায় অন্য সুর খেলা করে তার। নির্মাতা হওয়ার প্রবল আগ্রহ পেয়ে বসে তাকে। একটা সিনেমা ১২ বছর বয়সী একটা ছেলেকে এতোটা আলোড়িত করে, এতোটা ঘুরে ফেলে দেবে এটা নাকি মেহেরজুঁই স্বয়ং বুঝতে পারেননি। আর এর থেকেই ভেতরে ভেতরে দানা বেধে উঠে নির্মাতা হওয়ার বাসনা।

মেহেরজুঁইয়ের ‘পারি’ ছবির দৃশ্য… 

এর বছর কয়েক পর তিনি আমেরিকা পাড়ি দেন। লস অ্যাঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়ে যান তিনি। এবং পড়াশুনা করেন ‘ফিল্ম’ বিভাগ নিয়েই। আর সেখানেই সিনেমার হাতেখড়ি হয় মেহেরজুঁইয়ের। কিভাবে সিনেমা বানাতে হয়, কিভাবে ক্যামেরা চালাতে হয়, সাদামাটা একজন অভিনেতার কাছ থেকে কিভাবে সত্যিকারের অভিনয়টা আদায় করতে হয় সবই বুঝেন শুনেন। আর এই কাজে তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেন বিখ্যাত ফরাসি নির্মাত জ্যাঁ রেনোঁয়া।

সত্তরের শুরুতে তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন। এসে দুই বছর শিক্ষাদানেও ব্যস্ত ছিলেন তিনি, তেহরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন বিদেশি ভাষা ও সাহিত্য। এরপর হাত দেন নির্মাণের কাজে। ১৯৬৬ সালে প্রথমবার তিনি নির্মাণ করেন ‘ডায়মন্ড ৩৩’। একশো কুড়ি মিনিটের এই ছবিটি খুব একটা সাড়া না ফেলতে পারলেও তার দ্বিতীয় ছবি গাব(দ্য কাউ) ইরানি চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মত একটা ধাক্কা দেয়। সেই সাথে বিশ্ব সিনেমায়ও দারুণভাবে প্রভাব রাখে। এই ছবিটিই তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একজন নির্মাতা হিসেবে পরিচয় এনে দেয়। শুধু তাই না, ছবিটির এই ধারা ইরানি চলচ্চিত্রে ‘নিউ ওয়েব’-কে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যায়। সমৃদ্ধ করে ইরানি ছবির জগতকে। তার দেখাদেখি উদ্ভুদ্ধ হন আরো বেশ ক’জন তরুন নির্মাতা। অন্যদিকে মেহেরজুঁই একে একে নির্মাণ করতে থাকেন দ্য পোস্টম্যান, দ্য সাইকেল, হামুন, দ্য লেডি, সারা, পারি, লায়লা , টু স্টে এলাইভ , সান্তুরি, গুড টু বি ব্যাক এবং সর্বশেষ তিনি নির্মাণ  করেন ঘোস্ট নামের একটি ছবি।

শুধু ইরানি চলচ্চিত্র নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই গুণী নির্মাতা আশি বছর বয়সেও নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন নতুন ধারার চলচ্চিত্র।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.