চম্পক নগরে বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘর নাকি মন্দির?

নভেম্বর ২৬, ২০১৫

08শিবের ঔরসে সর্পদেবী মনসার জন্ম। জন্মের পর সে পালক মাতা বাসুকীর কাছে লালিত-পালিত হয়। বাসুকী তার কাছে গচ্ছিত শিবের ১৪ তোলা বিষ মনসাকে দিয়ে দেয়। এদিকে মনসার সৎ মা পার্বতী তাকে মেনে নিতে পারল না। তাই যুবতী মনসার এক চোখ পার্বতী অন্ধ করে দিল। সেই ক্ষোভে  মনসা পার্বতীকে দংশন করে। দংশন করার অপরাধে তাকে দীর্ঘদিনের বনবাস দেওয়া হয়। এরইমধ্যে ব্রহ্ম বীর্য ধারণ করে মনসা নাগ সন্তান জন্ম দেয় এবং সর্পদেবী আকারে হাজির হয়।

বনবাস থেকে ফিরে সে পিতার কাছে নিজের পূজা প্রচলনের দাবি করে। শিব বলেন, ‘যদি আমার একনিষ্ঠ ভক্ত ও পূজারী চাঁদ সওদাগর তোমার পূজা দিতে রাজি হয় তবে দুনিয়ায় তোমার নামে পূজার প্রচলণ হবে।’ কিন্তু শিব ভক্ত চাঁদ সওদাগর এক তুচ্ছ নারীকে পূজা দিতে রাজি তো হয়-ই না, উল্টো লাঠি নিয়ে মনসাকে তাড়া করে। যে কারণে মনসা চাঁদের চম্পক নগরে সাপের উপদ্রব বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে সর্পদংশনে একে একে চাঁদের ছয় সন্তানের মৃত্যু হয়। বাণিজ্যে লাভ করে প্রচুর পরিমাণ ধনসম্পদবোঝাই জাহাজ নিয়ে চাঁদ ফিরছিলেন তার চম্পক নগরে। প্রচণ্ড রোষের বসবর্তী হয়ে মনসা এক ঝড় উৎপন্ন করে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। প্রাণে বেঁচে চাঁদ এক দ্বীপে আশ্রয় নেয়, তবুও সে মনসার পূজা দিতে রাজি হয় না।

চম্পক নগরে ফিরে চাঁদ নতুন করে জীবন শুরু করে। জন্ম হয় এক পুত্র সন্তানের, তার নাম রাখা হয় লক্ষ্মীন্দর। চাঁদ যদি মনসার পূজা না দেয় তবে লক্ষ্মীন্দর বাসরঘরে সাপের দংশনে মারা যাবে। কথাটি জেনেও সে তার পুত্রের বিয়ে ঠিক করে ব্যবসায়িক মিত্র সাহার কন্যা বেহুলার সঙ্গে। সাপ যাতে দংশন করতে না পারে সেজন্য চাঁদ সওদাগর বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের জন্য দেবতা বিশ্বকর্মাকে দিয়ে তৈরি করায় একটি লোহার বাসরঘর। তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। কালনাগ লক্ষ্মীন্দরকে দংশন করে হত্যা করে। প্রচলিত প্রথা মোতাবেক সর্প দংশনে মৃত ব্যক্তির সৎকার না করে ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত। ধারণা করা হত মৃত ব্যক্তিটি কোনো অলৌকিক শক্তিবলে পুনরায় ফিরে আসবে।

সে বিশ্বাস থেকে লক্ষ্মীন্দরের মৃত দেহও ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বেহুলা নিজেও সে ভেলায় স্বামীর সঙ্গী হয়। ছয়মাস ধরে ভাসতে থাকে নানা ঘাটে ঘাটে। এই দীর্ঘ পরিক্রমার এক পর্যায়ে বেহুলা জানতে পায় স্বর্গের দেবতাদের নাচ দেখিয়ে খুশি করতে পারলে এর একটা বিহিত হতে পারে।  অবশেষে বেহুলা দেবপুরীতে পৌঁছে এবং দেবতাদের নাচ দেখিয়ে খুশি করতে সমর্থ হয়। দেবতাদের অনুরোধে মনসা লক্ষ্মীন্দরসহ চাঁদ সওদাগরের অন্য সন্তানদের জীবন ও ডুবে যাওয়া সমস্ত সম্পদ ফিরিয়ে দেয়। এই উপকারের কারণে বেহুলা মনসাকে কথা দেয় যে, সে তার শ্বশুর চাঁদ সওদাগরকে পূজা দিতে রাজি করাবে। সব কিছু দেখে চাঁদ খুশি হয় এবং মনসার পূজা দিতে রাজি হয়। এরপর থেকেই দুনিয়াতে মনসা পূজার রীতি চালু হয়। বিপ্রদাস পিপিলাই তার মনসামঙ্গল কাব্যে লক্ষ্মীন্দর-বেহুলার কহিনী এভাবেই বর্ণনা করেছেন।

বগুড়ার মহাস্থান গড় থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, গোকুল ও রামশহর নামক গ্রামের মাঝামাঝিতে অবস্থিত গোকুল ‘মেধ’। এই অতি উঁচু ঢিবিই লক্ষ্মীন্দরের মেধ বা বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘর বলে পরিচিত।

স্থানীয় লোকশ্রুতি রয়েছে, অতীতে ঢিবির উপর উঠলে সুদূর চলনবিলও নাকি দেখা যেত। প্রকৃত ঘটনা হল, ১৯৩৪-৩৬ খ্রিস্টাব্দে খনন করার ফলে এখানে একটি সুবৃহৎ ও আশ্চর্যজনক ইমারতের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। তার আগে জায়গাটি জঙ্গলাকীর্ণ একটি ঢিবি হিসেবেই দেখা যেত। বর্তমান অবস্থায় স্থাপনাটির উচ্চতা ১৩ মিটার। পূর্বের অবস্থায় বা অটুট অবস্থায় এটা যে আরো উঁচু ছিল, তাতে সন্দেহ নেই বলে গবেষকগণ মনে করেন। এই মেধ স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন। এখানে নানা আয়তনের ১৭২টি ভরাট কক্ষের সন্ধান পাওয়া গেছে। কক্ষগুলো বিভিন্ন তলায় বা একাধিক তলায় একই সারিতে নির্মিত। খননকার্যের চিত্রফলক ও অন্যান্য উপকরণও পাওয়া যায়। তা থেকে এর আদি নির্মাণকাল ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্তদের সময়ে ছিল বলে ধরা হয়।

 

প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা হল, বহুতল বিশিষ্ট এই স্থাপনার উপর আদিতে অতি উঁচু একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। কিন্তু সেই মন্দিরের কোনো চিহ্ন আজ খুঁজে পাওয়া যায় না। গবেষকগণ আরো প্রমাণ পেয়েছেন যে, একাদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে আর্থাৎ সেন আমলে এখানে দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণ কাজ করা হয়েছিল। তারা কাঠামো দেখে ধারণা করেছেন, এই পর্যায়ে নির্মিত ইমারতটি ছিল খুব সম্ভব একটি শিব মন্দির। বিপ্রদাস পিপিলাই রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে লক্ষ্মীন্দর-বেহুলর সঙ্গে গোকুল মেধ এর  আদৌ কোনো যোগসূত্র ছিল কিনা তার প্রকৃত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেবল জনপ্রবাদ অনুসারে এ স্থানকে বাংলার অত্যান্ত জনপ্রিয় এই লোকগাথা ’লক্ষ্মীন্দর-বেহুলা’র কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সেন আমলে এখানে যে একটি শিব মন্দির ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গবেষকদের মতানুসারে ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত আদি মন্দিরটি কি জন্য নির্মিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও একটি বৌদ্ধ মন্দিরের অস্তিত্ব যে এখানে ছিল তা ধারণা করা যায়।

অতএব, পণ্ডিত ও গবেষকদের অভিমত অনুযায়ী এটাকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীন্দর-বেহুলার কাহিনীটির কোনো ভিত্তি নেই।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.